মৃত্যুকে সেভাবে গুরুত্ব দেননি মহাভারতের ‘কবিরা’: ওয়েন্ডি ডনিগার

‘মহাভারত কোনো একক ব্যক্তির রচনা নয়। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে ফেরা নানা উপাখ্যান, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখক লিপিবদ্ধ করার ফলে মূল আখ্যানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন উপকাহিনি। সুতরাং মহাভারতের একটি সটীক সংস্করণ সম্পাদনা করা অসম্ভব।’

বলছিলেন বিশিষ্ট ভারতবিদ ও লেখক ওয়েন্ডি ডনিগার (Wendy Doniger)। যাঁর হাত ধরে বর্তমানে ‘মহাভারত’-এর কথা ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। ১৯ মার্চ, কলকাতার বেঙ্গল ক্লাবে ক্যান্টো আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব (Canto 2023) আয়োজিত এক আলোচনাসভায় তিনি আবার ডুব দিলেন মহাভারতের শেষ পর্বের বিবিধ আখ্যানে। উঠে এল কাব্যের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা বিবিধ রূপক, অলঙ্কার এবং অনুবাদের রাজনীতির প্রসঙ্গ। তবে এই আলোচনায় ওয়েন্ডি ছিলেন মূলত কথকের ভূমিকায়। ‘আফটার দ্য ওয়ার: দ্য লাস্ট বুকস অফ দ্য মহাভারত’ শীর্ষক এই আলোচনায় অন্তিম পর্বগুলির একের পর এক আখ্যানকে খানিক গল্পচ্ছলেই ছুঁয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। গল্পের সূত্রগুলি ধরে রেখেছিলেন ক্যান্টো কবিতা উৎসবের পরিচালক ও অন্যতম সঞ্চালক, বিশিষ্ট লেখক এবং প্রাবন্ধিক অভীক চন্দ (Avik Chanda)। বলে রাখা ভালো, আলোচনার শিরোনামটি ছিল, ওয়েন্ডির শেষ প্রকাশিত বইটির নামেই। 

গত ১৫ মার্চ থেকে ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে, ক্যান্টো আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব। যা বহুভাষিক, বহুসাংস্কৃতিক এবং ‘ভ্রাম্যমাণ’। একই মঞ্চে জড়ো হয়েছিলেন জর্জ সির্টেস, বিজয় শেষাদ্রি, কে সচ্চিদানন্দন, আলাপন বন্দোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, অমিত চৌধুরীর মতো খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরা। এই ঐতিহাসিক আয়োজনের সাক্ষী ছিল দিল্লি এবং কলকাতা। উৎসবের প্রথম পর্বটি হয় নয়া দিল্লির ‘ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো সেন্টার’-এ। ১৮ এবং ১৯ মার্চ দ্বিতীয় পর্বটি হয়েছিল কলকাতার বেঙ্গল ক্লাবে। বলা বাহুল্য বাংলা তথা ভারতে এমন আন্তর্জাতিক মাপের আয়োজন বিরল।

আলোচনার প্রথম পর্যায়ে উঠে আসে মহাভারতের ক্লে এবং ভাণ্ডারকর সংস্করণের প্রসঙ্গ। অভীক প্রশ্ন তোলেন—ভাণ্ডারকর সংস্করণে অন্তিম পর্বগুলি বাঁধা হয়েছে ৭৫,০০০ শ্লোকে। অথচ ওয়েন্ডির মতে অন্তত ১০০,০০০ শ্লোক এই শেষ পর্বগুলি জুড়ে রয়েছে। তবে কি সম্পাদনার কলম বহুলাংশে পরিহার করেছে কাব্যের পাকে পাকে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন উপকাহিনিকে? সেই শ্লোকগুলি ছাড়া কি মহাভারতের প্রামাণ্য সংস্করণ আদৌ সম্পূর্ণ? 

উত্তরে ওয়েন্ডি টেনে আনেন কৃষ্ণমৃত্যুর উপাখ্যান। মহাভারতের একটি পুঁথিতে, ব্যাধ ‘জরা’র শরে বিদ্ধ হলেন যোগধ্যানস্থ শ্রীকৃষ্ণ। বৈকুণ্ঠলোকে গমনের আগে অনুতপ্ত ব্যাধকে তিনি আশীর্বাদ করেন। এখানেই ফুরিয়ে যায় বর্ণনা। আবার অন্য একটি পুঁথিতে লিপিবব্ধ রয়েছে, যে কৃষ্ণহন্তা জরা দেহান্তের পর পরলোকে ঠাঁই পান, দেবগণের কৃপায়। 

জোহানেস ভ্যান বুইটেনেন অনূদিত মহাভারতের ক্লে সংস্করণের ক্ষেত্রেও প্রায় একই ঘটনা ঘটছে। ভ্যান বুইটেনেন মূল আখ্যানের দিকেই ধাবিত হয়েছেন অনেকক্ষেত্রে। বর্জ্যিত হয়েছে ছোটো ছোটো উপকাহিনীগুলি। অন্তিম পর্বের পুঁথিগুলি জুড়েই প্রায় ১৫০টি এমন উপকাহিনি পাওয়া যাবে, মূল কাব্যের সঙ্গে যেগুলির সম্পর্ক অতীব ক্ষীণ। 

উঠে এল গান্ধারীর অভিশাপের প্রসঙ্গও। গান্ধারকন্যার ক্ষমতা ছিল না শাপের বলে সহসা কৃষ্ণের মৃত্যুকে ডেকে আনার। বরং তিনি মানসচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন মৌষলপর্বকে। যেখানে মদ্যপ যাদবদের হাতে প্রাণ হারায় কৃষ্ণের দুই সন্তান। সন্তানহারা গান্ধারী কৃষ্ণের আসন্ন সন্তানশোকের কথাই মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মাত্র। যাদবকূলের ধবংসের অনুঘটক কৃষ্ণ ছিলেন না। কিন্তু সন্তানের মৃত্যু দেখতে দেখতে সংহারমূর্তি ধরেন তিনি…

“মৃত্যুকে কখনোই মহাভারতের ‘কবিরা’ সেভাবে গুরুত্ব দেননি। মৃত্যু যেন দেবগণ রচিত মায়াজাল। যেন একটি সাজানো নাটক। কারণ স্বর্গারোহণ পর্বে যুধিষ্ঠির বাদে পাণ্ডবরা একে একে মৃত্যুবরণ করলেও, নরকযন্ত্রণা ভোগ করলেও তাঁদের মিলিত হন স্বর্গলোকে।”—বলছিলেন ওয়েন্ডি।

কথায় কথায় যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বিদুরের যোগমিলনের প্রসঙ্গও টেনে আনলেন অভীক। বিদুর ও যুধিষ্ঠির—উভয়েই ধর্মের অবতার। অন্তিম মুহূর্তে বিদুরের আত্মা মিশে যায় ধর্মরাজের শরীরে। যেন বিদুরের নবজন্ম ঘটে যুধিষ্ঠিরের দেহে। এমন অভূতপূর্ব বর্ণনা হয়তো মহাভারতের আর কোনো আখ্যানেই নেই। 

তবে মৃত্যুর পরের পরিণতি নিয়ে মহাভারত কোনো একমাত্রিক কথা বলে না। ক্ষত্রিয়দের স্বর্গারোহণ যেন খানিক টিউটনিক পূরাণে ভাইকিং যোদ্ধাদের ভ্যালহাল্লায় প্রবেশের সামিল। ফলে যুধিষ্ঠিরের নরকগমন এক অর্থে স্বপ্নেরই মতো। 

কিন্তু একাকী যুধিষ্ঠিরের শেষ যাত্রার সঙ্গী কেন এক সারমেয়? যেখানে গোটা মহাকাব্য জুড়ে অশ্ব-হস্তির প্রসঙ্গই উত্থাপিত হয়েছে বারবার? অভীকের শেষ প্রশ্নটি কোথাও দর্শকদের কৌতূহল বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। 

ওয়েন্ডি বলেন, সরমার সন্তান সারমেয় আসলে ‘শূদ্র জীব’। কিন্তু যুধিষ্ঠির ভক্ত সারমেয়কে একাকি ফেলে রেখে যেতে চাননি। এই ‘ভক্তি’র ধারণার সঙ্গে ‘রাধা-কৃষ্ণে’র ভক্তির ধারণার পার্থক্য রয়েছে খানিক। হয়তো এই পর্বটি রচনাকালে বর্ণাশ্রম প্রথায় শিথিল হতে আরম্ভ হতে শুরু করেছিল। আবার সারমেয়কে ধর্মের আকার দিয়ে কোথাও স্ববিরোধী হয়ে পড়েছে মহাভারত। কিন্তু মহাকাব্যের সূচনাতেই রয়েছে জনমেজয়ের সারমেয় বিতাড়নের কথা। 

প্রশ্নোত্তর পর্বে উঠে এল মহাকাব্যে লিঙ্গচেতনার প্রশ্নও। অম্বা-শিখণ্ডীর আখ্যানে ডুবে গেলেন ওয়েন্ডি। উঠে এল ‘বিভিন্ন মহাভারতে’র প্রসঙ্গও। তবে পরিশেষে অভীকের কথাকেই কোথাও সমর্থন করেন ওয়েন্ডি। একমত হন দুজনেই— ‘যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে।’

Powered by Froala Editor