বাঁশের তৈরি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র, প্রান্তিক ঝাড়খণ্ডের শক্তিচাহিদা মেটাচ্ছেন কলেজছুট উদ্ভাবক

ভারতের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। সারাদিন তো দূরের কথা, রাতের বেলাটুকুও বিদ্যুৎ থাকে না সেখানে। পাওয়া যায় না মোবাইলের টাওয়ার। অথচ, এই প্রত্যন্ত গ্রামেই, সামান্য এক ঝর্ণার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র-ফেরত এক তরুণ গবেষক। শাহরুখ খান অভিনীত ‘স্বদেশ’ চলচ্চিত্রটির কথাই হচ্ছে। ২০০৪ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবির সঙ্গে পরিচিত আমরা সকলেই। তারপর কেটে গেছে প্রায় দু’দশক। তবে আজও ভারতের বুকে এমন বহু প্রান্তিক অঞ্চল রয়েছে, যেখানে পরিস্থিতি বদলায়নি এতটুকু।

ঝাড়খণ্ডের ডুমকি ব্লকের বায়াং গ্রাম তেমনই একটি অঞ্চল। মূলত কৃষিজীবী মানুষদেরই বাস সেখানে। বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে ঠিকই, কিন্তু ওই… দিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। বেশিরভাগ দিনই সন্ধের পর আলো জ্বলে না গ্রামের পথে। কখনও সেচের জন্য পাম্প চালানোই দায় হয়ে ওঠে কৃষকদের। এবার এই সমস্যারই অভিনব এবং পরিবেশ-বান্ধব এক সমাধান খুঁজে বার করলেন ঝাড়খণ্ডের ৩৪ বছর বয়সি উদ্ভাবক কেদার প্রসাদ মাহাতো (Kedar Prasad Mahato)। গ্রামের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা নদীর ওপরেই গড়ে তুললেন বাঁশের জলবিদ্যুৎকেন্দ্র (Hydel Powerplant)।

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন বাঁশের তৈরি হাইডাল প্ল্যান্ট। শুধু তাই নয়, স্বনির্মিত টারবাইন এবং জেনারেটর তৈরি করেও তাক লাগিয়েছেন কেদার প্রসাদ। আর এই সবটাই সম্ভব হয়েছে তাঁর একক উদ্যোগে। মজার বিষয় হল, ‘স্বদেশ’ ছবিতে শাহরুখ-অভিনীত মোহন চরিত্রটি আদতে ছিলেন নাসার এক গবেষক। আর আমাদের এই বাস্তব গল্পের নায়ক একজন কলেজ-ছুট। হ্যাঁ, আর্থিক সংকটের কারণে মাঝপথেই পড়াশোনা ছেড়েছিলেন কেদার প্রসাদ। তবে এমন একটা অসম্ভবসাধন করে দেখালেন কীভাবে তিনি? 

আসলে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই অপ্রচলিতভাবে বিদুৎ তৈরির প্রক্রিয়া বিশেষভাবে নজর কেড়েছিল তাঁর। আলু, পেঁয়াজের মাধ্যমেই ছোট্ট যে এলইডি বাল্ব জ্বালানো সম্ভব— এসব পরীক্ষানিরীক্ষা নিয়েই মেতে থাকতেন কেদার প্রসাদ। বয়স বাড়লেও সেই নেশায় ঘাটতি হয়নি এতটুকু। আর সেখান থেকেই ঘরোয়া পদ্ধতিতে এই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা। 

আর্থিক সামার্থ্য সামান্যই। তাই বাজারজাত টারবাইন বা অন্যান্য সামগ্রী কেনার সাধ্য ছিল না মোটেই। তাই বাঁশের মাধ্যমেই তিনি বানিয়ে ফেলেন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের খাঁচা। কাঠের তৈরি টারবাইন। বাকি বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের জন্য ছুটতে হয়েছিল বাজারে। তার জন্য ভাঙাতে হয় দু’লক্ষ টাকার সঞ্চয়। অবশ্য এতকিছুর পরেও গ্রামবাসীদের থেকে কোনো অর্থসাহায্য নেননি তিনি। 

গতবছর ৫ কিলোভোল্ট-অ্যাম্পিয়ারের এই মিনি হাইডাল প্ল্যান্টটি চালু হয়ে যায় বায়াং গ্রামের আমঝরিয়া নদীর ওপর। যা গ্রামের সমস্ত রাস্তা এবং দুটি মন্দিরকে বর্তমানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে বিনামূল্যেই। আশ্চর্য এই হাইডাল প্ল্যান্টের দেখাশোনার দায়িত্বও সামলান কেদার প্রসাদ নিজেই। 

সম্প্রতি, তাঁর এই আশ্চর্য উদ্যোগ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কৃষিকাজ ও প্রান্তিক উন্নয়নের জাতীয় ব্যাঙ্ক ‘নাবার্ড’। পরিবেশ-বান্ধব ও সাশ্রয়ী এই প্রকল্প প্রান্তিক অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যায় কিনা— তা নিয়েই পরীক্ষা চালাচ্ছে এই সংস্থা। কেদারের কথায় জাতীয় এই ব্যাঙ্কের থেকে উপযুক্ত অর্থসাহায্য পেলে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতাকে ৩০-৪০ কিলোভোল্ট-অ্যাম্পিয়ারের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম তিনি। তাতে অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পরিষেবা পাবেন গোটা গ্রামের মানুষ। পাশাপাশি অন্যান্য প্রান্তিক অঞ্চলেই সহজেই তৈরি করা যেতে পারে এই পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রতিলিপি। সবমিলিয়ে প্রান্তিক ভারতকে উন্নয়নের আলো দেখাচ্ছে কেদার প্রসাদ মাহাতোর এই উদ্যোগ…

Powered by Froala Editor

More From Author See More