একের পর এক হেরিটেজ স্থাপত্য ধ্বংস রাজ্যে, দায়ী কে?

/১০

‘টিনটোরেটর যীশু’ গল্পে নিয়োগীদের বাড়ি দেখে ফেলুদা আক্ষেপ করেছিলেন, বিদেশে হলে এইসব বাড়িকে হেরিটেজ তকমা দেওয়া হত। বাংলার আনাচে কানাচে এমন ইতিহাস তো কম নেই। হেরিটেজ তালিকায় রয়েছে খুব কম অট্টালিকাই। কিন্তু যে কাঠামোগুলি হেরিটেজ তকমা পেয়েছে, তাদেরই যথাযথ সংরক্ষণ হচ্ছে কি? অন্তত গত কয়েক বছরে নষ্ট হয়ে যাওয়া হেরিটেজ কাঠামোর সংখ্যাও তো নেহাৎ কম নয়।

/১০

২০১৫ সালের জুলাই মাস। সুন্দরবনের মাতলা নদীর ধারের একটি বাড়ির বারান্দা আর ছাদ ভেঙে পড়ল বর্ষায়। বাড়িটির বয়স নয় নয় করে ১৬০ বছর। এই বাড়িতেই একসময় থাকতেন সস্ত্রীক লর্ড ক্যানিং। এমনকি মাতলা নদীর উপর একটি বন্দর তৈরির পরিকল্পনাও করেছিলেন বড়োলাট। তাঁর বাড়িটির কারণেই শহরের নাম হয় ক্যানিং। বৃহত্তর কলকাতার ঐতিহ্যের অন্যতম স্মারক বাড়িটি সংরক্ষণের কোনো চেষ্টাই হয়নি তখনও পর্যন্ত। আর তার ফলেই সামান্য বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ে ছাদ। আজও সেই বাড়ি প্রায় ভগ্নস্তূপ হয়েই পড়ে আছে।

/১০

২০১৬ সালে ডিসেম্বর মাস। মাস পেরোলেই ২০০ বছরে পা দেবে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ নামে যার যাত্রা শুরু। ক্যাম্পাসজুড়ে তখন উৎসবের মেজাজ। আর ঠিক সেই সময় একদিন বুলডজারের ধাক্কায় ভেঙে পড়ল প্রতিষ্ঠানের মেন গেটটিই। দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য ক্যাম্পাসের নবরূপায়নের উদ্দেশ্যেই ভেঙে ফেলা হয় সেই ফটক। বর্তমানে সেখানে আরও প্রশস্ত একটি ফটক তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু ‘হেরিটেজ এ’ তকমাপ্রাপ্ত কোনো কাঠামো কীভাবে ভেঙে ফেলা যায়, তাই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল নানা মহলে।

/১০

২০২০ সালের জানুয়ারি মাস। আকস্মিকভাবে ভেঙে পড়ে বর্ধমান স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন পুরনো স্টেশনবাড়িটি। অট্টালিকাটির বয়স ততদিনে ১৫০ বছর ছাড়িয়েছে। ভারতে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার শুরু থেকেই বর্ধমান ছিল গুরুত্বপূর্ণ জংশন। সেকালের মহারাজাদের তৈরি করা স্টেশন বিল্ডিং দীর্ঘদিন ধরেই অযত্নে পড়ে ছিল। তার উপর পুরনো কাঠামোর উপরেই যত্রতত্র টাইলস বসানো এবং নতুন করে দেয়াল তোলার ফলে ভিত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে আবারও প্রশ্ন ওঠে সংরক্ষণের প্রক্রিয়া নিয়েই।

/১০

২০২০ সালের মে মাস। আমফানের দাপটে দক্ষিণবঙ্গের নাজেহাল অবস্থা। এর মধ্যেই এন্টালি অঞ্চলে হঠাৎ শোনা গেল কানফাটা শব্দ। এখানেই রয়েছে ২০০ বছরেরও বেশি পুরনো রানি রাসমণির বাড়ি। পরবর্তীকালে তাঁর বংশধরেরাও সেখানে থেকেছেন। কিন্তু এমন ঐতিহ্যশালী একটি বাড়িও সংরক্ষণ করার কোনো প্রচেষ্টাই নেওয়া হয়নি। স্থানে স্থানে গজিয়ে উঠেছিল আগাছা। কোথাও কোথাও আবার বট-অশ্বত্থের মতো গাছ। এমনই একটি গাছ উপড়ে পড়ার ফলে বাড়ির বারান্দা এবং ছাদ ভেঙে যায়।

/১০

আমফানের এক বছরের মাথায় দক্ষিণবঙ্গে আছড়ে পড়ে ইয়াস। আর সেই ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে মুছে গেল ফ্রেজরগঞ্জের খোদ ফ্রেজার সাহেবের বাংলোও। ১৯০৩ সালে ওড়িশা থেকে বাংলায় লেফট্যানেন্ট গভর্নর হয়ে এসেছিলেন অ্যান্ড্রু ফ্রেজার। কিন্তু কলকাতার ব্যস্ততায় তাঁর ভালো লাগত না। তাই সুন্দরবনের উপকূল ঘেঁষা ছোট্ট গ্রাম নারায়ণতলায় গড়ে তুললেন একটি বাড়ি। পরে গ্রামটিরই নাম হয়ে যায় ফ্রেজারগঞ্জ। তবে ১৯০৮ সালে ফ্রেজার সাহেব বদলি হয়ে যাওয়ার পর আর এই বাড়ির সংস্কারের কাজ কিছুই হয়নি। একটু একটু করে সমুদ্রের গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছিলই ফ্রেজার সাহেবের বাংলো। ইয়াস এসে এক লহমায় মুছে দিল সমস্তকিছু।

/১০

এর ঠিক কয়েকমাস পরের ঘটনা। ১৪ আগস্ট, সদ্য বর্ষা এসেছে। সেই বৃষ্টির মধ্যেই ঘটে গেল দুর্ঘটনা। লিলুয়ার রেল ওয়ার্কশপ সংলগ্ন সিনিয়র ইনস্টিটিউট হলের ছাদ ভেঙে পড়ল বৃষ্টিতে। ১৯০৬ সালে তৈরি হয় লিলুয়া সিনিয়র ইনস্টিটিউট হল। এলাকাবাসীর কাছে তা নাচঘর নামেও পরিচিত ছিল। কালক্রমে সেই বাড়িটি অনুষ্ঠান ভবনে পরিণত হয়। বিবাহ-অন্নপ্রাশনের মতো অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া হত। কিন্তু তার সংরক্ষণের জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। আর তার ফলেই সামান্য বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ে ছাদ।

/১০

প্রায় সমসময়েই বর্ধমানের পূর্বস্থলী অঞ্চলের নীলমণি ব্রহ্মচারী ইনস্টিটিউটের স্কুলবাড়িটির ভগ্নপ্রায় ছবি উঠে আসে। ১৮৮৭ সালে ভিক্টোরিয়া স্কুল নামে পথচলা শুরু করে এই স্কুল। এখানেই পড়াশোনা করেছিলেন কালাজ্বরের ওষুধের আবিষ্কারক উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। তাঁর পিতা নীলমণি ব্রহ্মচারীর নামে স্কুলটির নাম রাখা হয় পরে। দীর্ঘদিন ধরেই স্কুলবাড়ির বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়ছে বলে অভিযোগ জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এমনকি স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। চলতি বর্ষায় বাড়িটির প্রায় ৪০ শতাংশই মিশে গিয়েছে মাটির সঙ্গে। অবশেষে স্কুলের প্রাক্তনীরাই এগিয়ে এসেছেন সংস্কারের কাজে।

/১০

১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগের ঘটনা। বালুরঘাটের মোক্তারপাড়া এলাকার ১৯১৩ সালে তৈরি টাউন ব্যাঙ্ক ভেঙে ফেলল একদল প্রোমোটার। সরকারি খাতায় এই বাড়িটিও হেরিটেজ তকমা প্রাপ্ত। ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বহু আগেই। কিন্তু ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো বাড়িটিকে ঘিরে শহরবাসীর নানা স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। বুলডোজারের ধাক্কায় ভেঙে পড়ল সেইসব স্মৃতিও। যদিও বাড়িটির বর্তমান মালিক কারা, কাকেই বা তা বিক্রি করা হয়েছে – এই নিয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই প্রশাসনের কাছেও।

১০/১০

এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়ি। ১৮ সেপ্টেম্বর বাড়ির একটি অংশ সামান্য ভাঙা পড়েছিল। আর তার কয়েকদিন পরেই, ২৩ সেপ্টেম্বর বাড়ির একটি অংশ প্রায় পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। প্রায় ১২৫ বছরের পুরনো কাঠামোটি স্থানীয় মানুষদের কাছে সিংহদুয়ার নামেই পরিচিত ছিল। একসময় বাড়িতে বাঘ বাঁধা থাকত বলেও শোনা যায়। এই বাড়িতেই ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ সিনেমার একাংশের শুটিং হয়েছিল। বাড়িটি ভেঙে পড়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন পরিচালক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ও। এভাবে আরও কত বাড়িই অযত্নে ভেঙে পড়বে আবারও। কোনোটা ভেঙে আবার উঠবে আধুনিক বহুতল। এভাবেই ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে এবং যাবেও। এখনই সচেতন না হলে কোনোকিছুই বাঁচানো যাবে না।

Powered by Froala Editor

More From Author See More