বাংলার বুকে একটুকরো বিলেত, হেরিটেজ তকমা পেতে চলেছে ধান্যকুড়িয়া

রাস্তাজুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুবিশাল ফটক। তার দু’দিকে উঠে গেছে বৃত্তাকার দুটি স্তম্ভ। তার মাঝে ধনুকাকৃতি ঝুলন্ত ছাদ। মাথায় পাথরে খোদাই করা একটি মূর্তি। ছোরা দিয়ে সিংহ বধ করছেন এক সাহেব। একেবারে সনাতনী ভিক্টোরিয়ান গঠন যাকে বলে। আর এই ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই প্রকাণ্ড এক রাজবাড়ি। রাজবাড়ির থেকে তাকে দুর্গ বলাই শ্রেয়। হঠাৎ করে এমন জায়গায় এসে হাজির হলে মনে হবে যেন স্বপ্নরাজ্যে।

বসিরহাটের নিকটবর্তী ছোট্ট জনপদ ধান্যকুড়িয়া। সেখানে গেলেই দেখা মিলবে এই আশ্চর্য স্থাপত্যের। হ্যাঁ, বিদেশের কথা নয়; এই ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে বাংলাতেই। যার প্রতি দেওয়ালে দেওয়ালে লুকিয়ে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। এবার এই ঐতিহাসিক ‘গায়েন বাড়ি’-তো বটেই, ধান্যকুড়িয়া জনপদটিই পেতে চলেছে হেরিটেজ তকমা। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে সেই আইনি প্রক্রিয়াও। আর কয়েকদিনের অপেক্ষামাত্র। তারপরেই ‘ঐতিহ্যবাহী’-র তকমা পাবে ‘গায়েন বাড়ি’।

আজ থেকে প্রায় দুশো তিরিশ বছর আগের কথা। সুবিশাল এই রাজবাড়ি বানিয়েছিলেন ধান্যকুড়িয়ার জমিদার মহেন্দ্রনাথ গায়েন। সেসময় ফুলেফেঁপে উঠেছিল তাঁর পাটের ব্যবসা। মূলত ইংরেজদের সঙ্গেই চলত তাঁর লেনদেন। আর সেই সুবাদেই উত্তর ২৪ পরগণার এই প্রান্তিক অঞ্চলেও নিত্যদিন লেগে থাকত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবদের আনাগোনা। তাঁদের বিলিতি সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে উস্কে দিতেই ইউরোপীয় দুর্গের আদলে এই রাজবাড়ি নির্মাণ করেন মহেন্দ্রনাথ। 

৩০ একর জায়গায় জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই রাজবাড়ির মধ্যেই রয়েছে আস্ত এক পুষ্করিণী, যাতে রাজবাড়ির প্রতিচ্ছবি ঝলমল করে সারাদিন। গোটা দুর্গটিকে কেন্দ্র করে রয়েছে বিশাল এক বাগানও। দুর্গের ভেতরে ঢুকলেও রীতিমতো চমকে যেতে হবে। নানা ধরনের ভিক্টোরিয়ান কারুকাজ থেকে শুরু করে রয়েছে ইতালিয় কাচের তৈরি আসবাব। যা এক কথায় মন্ত্রমুগ্ধকর। গ্রীষ্মকালে এই রাজবাড়িতে এসে অনেক সময়ই ছুটি কাটাতেন ব্রিটিশ সাহেবরা। তাঁদের জন্য ছিল পৃথক নহবতখানা, অতিথিশালা। এমনকি সেসময় এই রাজবাড়ির জন্য পৃথক রেল স্টেশনও তৈরি করেছিল মার্টিন কোম্পানি। গায়েন গার্ডেন নামের সেই স্টেশনে এসে থামত ন্যারো গেজের ছোট্ট বাষ্পচালিত ট্রেন।

আরও পড়ুন
হেরিটেজ তকমা হারাতে চলেছে লিভারপুল, কিন্তু কেন?

বর্তমানে অবশ্য সেই স্টেশনের অস্তিত্ব নেই আর। ২০০৮ সালে তা অধিগ্রহণ করে সরকার। গড়ে ওঠে অনাথ মেয়েদের সরকারি হোম। তবে মূল বাড়িটির কিছু অংশের পুনর্নির্মাণ হলেও, সামগ্রিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধুঁকছে এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যটি। বাড়ির সামনে অবস্থিত শ্বেত পাথরের দুটি সিংহ মূর্তির একটি চুরি গিয়েছিল বহু আগেই। কয়েক বছর আগে আরেকটি সিংহও চড়া দামে বিক্রি করে দেন মহেন্দ্রনাথের উত্তরসূরিরা। 

আরও পড়ুন
হেরিটেজ তকমা পেল অপু-ত্রয়ীর ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্রের বাড়ি

তবে শুধু ঔপনিবেশিক ইতিহাসই নয়, এই বাড়িতে শুটিং হয়েছে ‘সত্যান্বেষী’, ‘সাহেব-বিবি-গোলাম’, ‘সূর্যতপা’-সহ একাধিক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রেরও। অভিনয় করে গেছেন স্বয়ং উত্তমকুমার। এমনকি বিদেশি বিভিন্ন চলচ্চিত্রেরও শুট হয়েছে এই দুর্গেই।

আরও পড়ুন
বিপদের মুখে ইউনেস্কো-র ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট, গোয়া সরকারের সমালোচনায় প্রকৃতিবিদরা

আশ্চর্যের বিষয়, সব কিছুর ব্যাপারে অবগত হয়েও সংরক্ষণে উৎসাহ দেখায়নি স্থানীয় প্রশাসন। সম্প্রতি, ঐতিহাসিক এই রাজবাড়ির সংরক্ষণে উদ্যোগী হয় রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। বাড়ির উত্তরসূরিদের সঙ্গে কথা বলেই, স্বাক্ষরিত হয় চুক্তি। শুরু হয়ে গেছে সেই আইনি প্রক্রিয়াও। হেরিটেজ তকমা পাওয়ার পর যে অবহেলা থেকে মুক্ত হবে এমন একটি স্থাপত্য, সে ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী হেরিটেজ কমিশন। 

তবে শুধু গায়েনবাড়ি নয়। ধান্যকুড়িয়ায় গায়েন বাড়ির এক কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে আরও দুটি এই একই ধাঁচের দুর্গ— সাউবাড়ি আর বল্লভবাড়ি। সেগুলিও তৈরি পুরোপুরি ইউরোপিয় আদলে। এই বাড়িগুলিকেও দ্রুত ঐতিহ্যবাহী নির্মাণের আওতায় আনা হবে বলেই জানাচ্ছেন হেরিটেজ কমিশনের আধিকারিকরা। পাশাপাশি গোটা অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্কুল, মন্দির ও অন্যান্য নির্মাণগুলিকেও ধীরে ধীরে হেরিটেজ তকমা দেওয়া হবে। শুরু হবে সংস্করণ প্রক্রিয়া। ছোট্ট জনবসতিতে অজস্র ঐতিহাসিক নির্মাণের জন্য ‘প্রাসাদঘেরা গ্রাম’ নামেই পরিচিত ধান্যকুড়িয়া। তবে সংস্কার এবং প্রচার অভাবে, আজ প্রায় তা বিস্মৃতপ্রায়। হেরিটেজ কমিশনের এই উদ্যোগ সেই ইতিহাসকেই আবার পুনরুজ্জীবিত করে তুলবে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো…

Powered by Froala Editor