বাংলায় রাজত্ব করতেন পরশুরাম! প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে এখনও

পুরাণের পরশুরামের কথা তো সবাই জানেন। কয়েকদিন আগেই তাঁর জন্মতিথিও পালন করা হল বেশ ঘটা করেই। কিন্তু পরশুরাম যে বাংলায় রাজত্বও করেছেন, সে হদিশ অনেকেই রাখেন না। বাংলাদেশের মহাস্থানগড়ে সন্ধান পাওয়া গিয়েছে তাঁর প্রাসাদেরও। অবশ্য এসব পৌরাণিক যুগের কথা নয়। দ্বাদশ শতকে মহাস্থানগড়ে রাজত্ব করেছেন পরশুরাম। আর তাঁর প্রাসাদের হদিশ মিলেছে গত শতকেই। ১৯০৭, ১৯৬১ এবং ১৯৯৫ সালে তিনটি খননকার্যে প্রাসাদের তিনটি স্তর আবিষ্কার করেন প্রত্নতাত্বিকরা।

তবে এখনও পর্যন্ত পরশুরামের প্রাসাদের প্রকৃত ইতিহাস নিয়ে নিশ্চিত নন ঐতিহাসিকরা। সম্বল শুধুই কিছু জনশ্রুতি। শোনা যায় ১০৮০-১১২৫ সাল পর্যন্ত মহাস্থানগড়ের রাজা ছিলেন নীল। তিনি ছিলেন পালরাজা নলের ছোটো ভাই। এই সময়েই দাক্ষিণাত্যের শ্রীক্ষেত্র থেকে বাংলায় আসেন এক অভিশাপগ্রস্ত ব্রাহ্মণ। তাঁর বাবা জমদগ্নি। মা রেণুকাকে নিজের হাতে হত্যা করেছে সন্তান। আর এই ব্রাহ্মণের নাম? পুরাণে যা ছিল তাই। অর্থাৎ পরশুরাম। প্রথমে নল ও নীল নামক দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসার কাজ শুরু করেন পরশুরাম। ক্রমশ তাঁদের প্রতারিত করে নিজেই রাজা হয়ে বসেন। তবে এই সুখ বেশিদিন সহ্য হল না। কিছুদিনের মধ্যেই শাহ সুলতান বলখী মহিসওয়ার এসে দখল করলেন পরশুরামের রাজত্ব।

তবে পরশুরামের প্রাসাদ নামে যেটি পরিচিত, তার পুরোটা পাল রাজত্বের সময় তৈরি নয়। একেবারে ওপরের স্তরটি কিছুতেই অষ্টাদশ শতকের আগে তৈরি নয়। এখান থেকে কোম্পানি শাসনের সময়কার মুদ্রাও পাওয়া গিয়েছে। আর মাঝের স্তরটি তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ সুলতানি আদলেই। তবে একেবারে নিচের স্তরটি বেশ প্রাচীন। এবং তার গঠনশৈলীর সঙ্গে পালযুগের স্থাপত্যের যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়। এই স্তরটি আবিষ্কৃত হয়েছে মাত্র ১৯৯৫ সালে।

পরশুরামের প্রাসাদের অনতিদূরেই আছে এক বিশাল কুয়ো। স্থানীয় মানুষদের কাছে তার নাম জিয়নকুণ্ড। এই নামের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এক কাহিনি। মহিসওয়ার যখন মহাস্থানগড় আক্রমণ করলেন, তখন পরশুরামের সেনাবাহিনী নাকি অনেকটাই ছন্নছাড়া। এমনকি তাঁর নিজের সেনাপতিও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সুলতানের দলে যোগ দিয়েছেন। তবু দেখা গেল, যুদ্ধে পরশুরাম অপ্রতিরোধ্য। সুলতানের সৈন্যরা যুদ্ধে প্রাণ হারাচ্ছেন, সৈন্যক্ষয় হচ্ছে। কিন্তু পরশুরামের বাহিনীর সৈন্যক্ষয় হচ্ছে না। চোখের সামনে যে সৈন্য মারা গেল, সেই আবার উঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ শুরু করে। পরে জানা গিয়েছিল, এই কুয়োর জলেই মন্ত্র পড়ে রেখেছেন পরশুরাম। সেই জল মাথায় ঢাললেই মৃত মানুষ জেগে উঠবে।

আরও পড়ুন
গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান আবিষ্কার, নেপথ্যে বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিক

তবে এই অলৌকিক শক্তি দিয়েও সুলতানের বাহিনী ঠেকানো যায়নি। সুলতান সব জানতে পেরে একদিন গোপনে কুয়োর জলে গোমাংস ফেলে দিলেন। ব্যাস, জলও তার অলৌকিক ক্ষমতা হারাল। এরপর মহাস্থানগড় দখল করতে কষ্ট পেতে হয়নি মহিসওয়ারকে। পরশুরাম তো যুদ্ধক্ষেত্রেই প্রাণ হারালেন। আর তাঁর বোন অথবা কন্যা শীলাদেবী করতোয়ার জলে ডুবে আত্মহত্যা করলেন। এর সঙ্গেই শেষ হল মহাস্থানগড়ের শেষ হিন্দু রাজার শাসন। তবে এইসবই নিছক গল্পকথা। প্রকৃত ইতিহাসের সন্ধান পেতে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন। তবে হিন্দু শাসন থেকে সুলতানি শাসন এবং পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যে এই প্রাসাদ জড়িয়ে, তা ইতিমধ্যে প্রাপ্ত নমুনা থেকেই স্পষ্ট।

আরও পড়ুন
১০০১টি গির্জার ধ্বংসাবশেষ নিয়ে, কেমন আছে তুরস্কের এই পরিত্যক্ত শহর?

তথ্যসূত্রঃ
১. মৃতকে জীবিত করে যে কূপ!, মাদারীপুর দর্পন
২. Bangladesh Heritage Study And Development Foundation

আরও পড়ুন
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নিচে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ - যে আবিষ্কারে চমকে উঠেছিল গোটা বিশ্ব

Powered by Froala Editor

More From Author See More