ভোলাডোরস অফ ভেরাক্রুজ : বাংলার চড়কের ছায়া মেক্সিকোর এই উৎসবে

মাঠের মাঝে পোঁতা প্রকাণ্ড এক কাঠের স্তম্ভ। উচ্চতা কমপক্ষে ১৮ মিটার। তার মাথায় ওপর বসানো চৌকো ফ্রেমের ছোট্ট একটি ঘূর্ণায়মান মঞ্চ। সেই মঞ্চের চারটি কোণা থেকে পায়ে দড়ি বেঁধে উল্টো হয়ে ঝুলে রয়েছেন চারজন ব্যক্তি। সেইসঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাজছে বাদ্যযন্ত্র, চলছে গান।

একঝলক এই দৃশ্য দেখলে মনের মধ্যে ভেসে উঠবে ‘চড়ক’ (Charak) শব্দটা। তবে মজার বিষয় হল, এই দৃশ্য বাংলার নয়। মেক্সিকোর (Mexico) ভেরাক্রুজ প্রদেশে। সেখানে গেলেই দেখা মিলবে এই আশ্চর্য উৎসবের। স্থানীয় ভাষায় যার পরিচয় ‘ভোলাডোরস অফ ভেরাক্রুজ’ (Voladores of Veracruz) বা ‘ড্যান্সা দে লা ভোলাডোরস’। মেক্সিকোর এই উৎসব যেন বাংলায় চড়কেরই প্রতিফলন। এমনকি মজার বিষয় হল, চৈত্র সংক্রান্তিতে যেমন পালিত হয় চড়ক, তেমনই মেক্সিকোর এই উৎসও পালিত হয় গ্রীষ্মেই। 

তবে সংস্কৃতিগত দিক থেকে দেখতে গেলে চড়কের থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা ভোলাডোরসের নেপথ্য কাহিনি। এমনকি প্রাচীনতার দিক থেকেই চড়ককে হার মানায় এই মেক্সিকান উৎসব। একটি মত অনুযায়ী, ১৪৮৫ সালে চড়কের সূত্রপাত হয়েছিল রাজা সুন্দরানন্দ ঠাকুরের হাত ধরে। পরবর্তীতে বাংলার অন্যান্য জমিদাররাও ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন চড়কের সঙ্গে। যে-সকল কৃষকরা বার্ষিক খাজনা দিতে ব্যর্থ হত, তাঁদেরকে বড়শির সূচালো ফলায় গেঁথে ঝুলিয়ে দেওয়া হত চড়ক গাছে। 

অন্যদিকে মেক্সিকোর ভোলাডোরসের সঙ্গে এমন কোনো নৃশংস ইতিহাস জড়িয়ে নেই। বরং, এক্ষেত্রে এই উৎসবে মেক্সিকান কৃষকরা অংশ নিতেন স্বেচ্ছায়। গ্রীষ্মকাল অনাবৃষ্টির সময়। তাছাড়া সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে হামেশাই হানা দিত ঘূর্ণিঝড়। তাই প্রকৃতিকে তুষ্ট করাতেই প্রচলন এই উৎসবের। 

ভেরাক্রুজের নিকটবর্তী এল তাজিন প্রত্নক্ষেত্রে আবিষ্কৃত প্রাচীন ছবি, প্রত্নসামগ্রী থেকে গবেষকদের ধারণা এই উৎসবের প্রচলন হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১২০০ বছর আগে। সে-সময় মেক্সিকোর একাধিক ছোটো ছোটো জনগোষ্ঠীর মধ্যে পালিত হত এই উৎসব। পরবর্তীতে যা জায়গা করে নিয়েছিল অ্যাজটেক সংস্কৃতিতেও। ষোড়শ শতকে, স্প্যানিশ বাহিনীর আক্রমণের আগে পর্যন্ত অ্যাজটেক সভ্যতার অন্যতম অঙ্গ ছিল ভোলাডোরস। ষোড়শ শতকের পর, ঔপনিবেশিক শাসনকালে ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হতে বসেছিল এই উৎসব। কেবলমাত্র টোটোনাক উপজাতির মানুষরাই বাঁচিয়ে রেখেছিল এই সহস্র বছরের পুরনো সংস্কৃতিকে। 

তবে সময় বদলেছে। বর্তমানে শুধু ভেরাক্রুজ নয়, গোটা মেক্সিকো-জুড়েই পালিত হয় ভোলাডোরস। এমনকি তরুণদের এই উৎসবে আগ্রহী করে তুলএ ভেরাক্রুজের তাকিলসহুকুট পার্কে তৈরি হয়েছে বিশেষ স্কুল। যেখানে কিশোরদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এই আশ্চর্য ‘স্টান্ট’-এর। পরিচয় করানো হয় প্রাচীন মেক্সিকান সংস্কৃতি, ভাষা, গান, বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গেও। ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এ এক আশ্চর্য উদ্যোগই বটে। 

চলতি শতকের শুরুর দিক। এই উৎসবকে ‘সংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য ইউনেক্সোর কাছে আবেদন করেছিল মেক্সিকান প্রশাসন। ২০০৯ সালে সেই তকমা পায় ভোলাডোরস। আন্তর্জাতিক এই স্বীকৃতির পর ভেরাক্রুজ তো বটেই, বদলে গেছে মেক্সিকোর ছবিও। প্রতি বছর এই উৎসব চাক্ষুষ করতে বিদেশ থেকে মেক্সিকোয় হাজির হন হাজার হাজার পর্যটক। সবমিলিয়ে এই উৎসবই এখন যেন হয়ে উঠেছে মেক্সিকোর অন্যতম প্রতীক। অন্যদিকে নগরায়নের জেরে ক্রমশ নিজের জৌলুষ হারাচ্ছে বাংলার চড়ক। মেক্সিকো প্রশাসনের এই উদ্যোগই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাকে।

Powered by Froala Editor