সাইকেলের ব্যবহার বাড়লে ভালো থাকবে কলকাতাও

"হাওয়ার উপর চলে গাড়ি
লাগে না পেট্রোল ডিজ়েল
মানুষ একটা দুই চাকার সাইকেল"
~ বাউল মুনির সরকার

১৮১৭ সাল; ঘটনা ১

যুদ্ধে ও প্রবল শীতে, তারপর খাদ্যের অভাবে দশহাজার ঘোড়ার মৃত্যু হয়েছিল ইউরোপে। ১৮১৭ সালে কিছুটা এই ঘোড়ায় চড়া যাতায়াতের বিকল্প হিসেবেই তৈরি হয়েছিল সাইকেলের আদিরূপ 'ড্যান্ডি হর্স' - মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম দুই চাকার বাহন। যাও কিনা চাকা আবিষ্কারের প্রায় ৬০০০ বছর পরের ঘটনা।

১৮৮৫ সাল;  ঘটনা ২

আরও পড়ুন
শিল্পের পাশাপাশি, অস্বস্তিতে পড়ার জন্যেও ‘পার্সেল’ দেখা প্রয়োজন আমাদের

প্রায় ৭০ বছর ধরে চলল চেহারার অদল-বদল। ১৮৮৫ সাল নাগাদ তৈরি হল 'সেফটি বাইসাইকেল'। দুটি সমান মাপের চাকা - সকলের চলার উপযোগী। এরপর ক্রমশ জনপ্রিয় হতে শুরু করল সাইকেল। ইউরোপে তৈরি হয়ে, পৌঁছে গেল সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।

১৯১৮ সাল : ঘটনা ৩ 

আরও পড়ুন
১৮৯১-এর পর এই প্রথম ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের মুখোমুখি মুম্বাই, আছড়ে পড়বে আজই

পৃথিবীজোড়া স্প্যানিশ ফ্লুয়ের আবহের মধ্যে আবার বাড়তে শুরু করল সাইকেলের ব্যবহার। গণপরিবহন এড়িয়ে সাইকেল বেছে নেওয়ার হিড়িক পড়ে গেল। নিয়মিত সাইকেল চালালে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে - এমনও লেখা থাকত বিজ্ঞাপনে।

২০২০ সালের জুন মাস:  ঘটনা ৪

আরও পড়ুন
মুছে গেল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের প্রাচীনতম ভাষা ‘সারে’, করোনা কেড়ে নিল শেষ বক্তার প্রাণ

কোভিড১৯ এর মহামারী ও বিপর্যয়। সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সমাধান না হওয়া দূষণ, যানজট অধ্যুষিত শহর ও জলবায়ু সংকট। সংক্রমণ এড়াতে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরের মতো কলকাতার মানুষ দলে দলে বেছে নিচ্ছেন সাইকেল।

গতকাল চলে গেল 'বিশ্ব সাইকেল দিবস'। ২০১৮ সালে শুধুমাত্র সাইকেলের জন্য ৩রা জুন তারিখটি বরাদ্দ করে রাষ্ট্রপুঞ্জ। আবিষ্কারের ২০০ বছর পর কেন সাইকেলের জন্য এই উদযাপন? কারণ বোধহয় এই, যে সমাজ-সংস্কৃতিতে এর অবদান ও সম্ভাবনা আমরা ভুলতে বসেছি। সাইকেলকে গুরুত্বহীন, কষ্টসাধ্য, অদৃশ্য, অসম্ভব ও একরকম 'এলেবেলে' হিসেবে দেখার একটা চোখ তৈরি হয়েছে আমাদের। গত ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির বিপণন কৌশল এক্ষেত্রে মানুষের অবচেতনে দীর্ঘ প্রভাব ফেলে থাকতে পারে। তবে এই মুহূর্তে, অফিসের শেয়ার গাড়িতে বা আ্যপক্যাবে যাতায়াতের অভ্যাসে থাকা চাকুরীজীবী আজ বাড়ির  এককোণে, অযত্নে পড়ে থাকা সাইকেলটির মর্ম বুঝছেন নতুন করে। সৌজন্যে কোভিড১৯ ।

আরও পড়ুন
খেলরত্নের জন্য মনোনীত রোহিত, অর্জুন পুরস্কারের মনোনয়ন তালিকায় তিন ক্রিকেটার

অথচ মানবকল্যাণে সাইকেলের অবদান কিছু কম নয়। উচ্চবিত্তের নির্দিষ্ট গণ্ডি ছেড়ে সাইকেল সর্বসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় হতে শুরু করে সেই উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে। বিগত প্রায় ১৩০ বছর ধরে সাইকেল প্রান্তিক আয়ের মানুষের সহায়সম্বল হয়ে থেকেছে। বিনা খরচে মানুষকে পৌঁছে দিয়েছে কর্মস্থলে, বাজারে, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজে, শহরে। মেয়েদের স্বাধীন চলাফেরায় ও ক্ষমতায়নে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। উল্টে একবিন্দু দূষণ তৈরি করেনি। বরং শরীর-মন ভালো রেখেছে। সুস্থ, সহজ ও অনাড়ম্বর জীবনের প্রতীক হয়ে উঠেছে এই সাইকেল।

আরও পড়ুন
ব্রিটিশ দ্বীপের মধ্যেই রয়েছে ‘অজ্ঞাত’ এক দেশ, বসবাস করত দস্যুরাও

কলকাতা পুরসভা জানাচ্ছে, গত ২০ মে-র আমফান ঝড়ে প্রায় ১৫,০০০ গাছ পড়ে গেছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, লকডাউন সম্পূর্ণ উঠে যাওয়ার পর গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেলে বায়ুদুষণ আরো ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতে পারে শহরে। এই প্রসঙ্গে একটা অভিনব তথ্য দেওয়া যাক। রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী নেদারল্যান্ডসের মানুষ গাড়ি বাদ দিয়ে  যে পরিমাণ সাইকেল চালান ও তার ফলে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন কম হয়, তা কোনো একটি বছরে সাড়ে ৫ কোটি বৃক্ষরোপণের সমতুল্য। 

রাজধানী আমস্টারড্যাম শহরের মোট চলাফেরার প্রায় ৬৭ শতাংশই হয় সাইকেলে। হল্যান্ড, ডেনমার্ক বা বেলজিয়ামের মত ইউরোপের বেশ কিছু দেশ বিগত প্রায় ৫০ বছর ধরে নগরপরিবহন ব্যবস্থায় সাইকেল ও অন্যন্য অ-মোটরচালিত যানবাহনকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। প্যারিস, লন্ডন তো বটেই, সেইসঙ্গে কলোম্বিয়ার বোগোটা কিম্বা ইউগান্ডার কাম্পালায় জরুরি ভিত্তিতে তৈরি বা সম্প্রসারিত করা হচ্ছে সাইকেল-লেন। অকারণে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ সহজ তো হয় বটেই। সেই সঙ্গে শহর হয়ে ওঠে অনেক বেশি নিরাপদ ও বাসযোগ্য। সাইকেল - বান্ধব শহর সমস্ত মানুষের, বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের স্বাধীন জীবিকার পথ আরো সুগম করতে পারে। শিশু ও বয়স্করা রাস্তায় নির্ভয়ে হাঁটাহাঁটির সুযোগ পান। 

এইসব ছোটো ছোটো বদলগুলো একটা জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে আরও প্রাণবন্ত, কর্মচঞ্চল করে তোলে। একটা বড় সাভ গাড়ির জায়গায় প্রায় ৭/৮ টা সাইকেল অনায়াসে জায়গা করে নিতে পারে। আর সেই গাড়িতে যদি একজন যাতায়াত করেন, তাহলে তার প্রভাব কি হতে পারে, আমরা বুঝতে পারি ভারতের শহরগুলোর বাস্তব অভিজ্ঞতায়। একজন মানুষ যদি সাত-আটজনের রোডস্পেস দখল করেন, তাহলে তিনি সোজা হিসেবে সমসংখ্যক মানুষের জীবন জীবিকার সম্ভাবনাকে কোণঠাসা করে দিচ্ছেন। এগুলো যদি ভিতরের কথা হয়, বাইরের দৃশ্যমান প্রভাব হল, তীব্র যানজট ও বিশৃঙ্খলা, হর্নের অমানুষিক আওয়াজ এবং সহনশীল অবস্থার থেকে অনেক বেশি মাত্রার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স। যার প্রভাবে শ্বাসকষ্টজনিত অসুখ, ফুসফুসের ক্যানসার, হয়তো বা করোনাভাইরাসের কো-মর্বিডিটিও।

কলকাতা শহরের গড় যাতায়াতের দূরত্ব ৫/৬ কিলোমিটারের মধ্যে। যা অনায়াসে যেকোনো সুস্থ মানুষ সাইকেল নিয়ে যেতে পারেন। তবে পাশাপাশি চাই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। সাময়িকভাবে রাস্তার একটি অংশ চিহ্নিত ও নির্দিষ্ট করে সাইকেল ব্যবহারে উৎসাহ দিক সরকার। পরে পরিকল্পনা অনুযায়ী সামগ্রিক সাইকেল পরিকাঠামো বানানোর উদ্যোগ নেওয়া হোক। বস্তুত কেএমডিএ-র পক্ষ থেকে গতবছর ডিসেম্বর মাসে এরকম একটি পরিকল্পনার রোডম্যাপ বানানোর কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। অবিলম্বে রাস্তার 'নো সাইক্লিং বোর্ড'গুলো সরিয়ে, সাইকেল নিষেধাজ্ঞার নির্দেশটি প্রত্যাহার করে নেওয়া প্রয়োজন। ভারতের বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও জাতীয় পরিবহন নীতিতে সাইকেলকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা সুপারিশ করা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য প্রতিনিধিদের সংগঠন সম্মিলিত চিঠি দিয়েছে জি২০ অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধানদের। লকডাউনের পর আমাদের শহরগুলো যদি আগের সেই দূষিত অবস্থায় ফিরে আসে, এই মুহূর্তের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তা আরো মারাত্মক হতে পারে। তারা চান 'গ্রিন রিকভারি'।

তাই রাস্তার সমানাধিকার শুধু নয়, সাইকেল এখন অগ্রাধিকার পাক শহরে, মফস্বলে, গ্রামাঞ্চলে সর্বত্রই। 

ফিরে আসি বিশ্ব সাইকেল দিবসের ভাবনায়। এর সঙ্কল্পপত্রে ঘোষণা করা হয়েছিল যে সাইকেল মানবিক যোগাযোগ ও সামাজিক সহনশীলতা বাড়ায়। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির পথ প্রশস্ত হয়। সাইকেলের ব্যবহার বাড়লে সমাজে একটা সাম্যতভাব আসতে পারে। 

অদ্ভুত এই সংকটে আমরা আজ 'সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং' নিশ্চিত করার জন্য সাইকেল বেছে নিচ্ছি। আদতে যাকে শারীরিক দুরত্ব বলা ভালো। আর সামাজিকভাবে বিভিন্ন মানুষকে অজান্তেই পরস্পরের কাছে এনে দিচ্ছে সাইকেল। আবার পাশাপাশি, ব্যক্তিমানুষকে দিচ্ছে নির্জন ও অনাবিল মুক্তির স্বাদ।

১৯১১ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প 'পণরক্ষা' থেকে একটি অংশ তুলে দেব। 'বাইসিকল'-এর বর্ণনা - "কী চমৎকার, কী স্বাধীনতা, কী আনন্দ! দূরত্বের সমস্ত বাধাকে এই বাহনটা যেন তীক্ষ্ণ সুদর্শনচক্রের মতো অতি অনায়াসেই কাটিয়া দিয়া চলিয়া যায়। ঝড়ের বাতাস যেন চাকার আকার ধারণ করিয়া উন্মত্তের তো মানুষকে পিঠে করিয়া লইয়া ছোটে।"

(লেখক আন্তর্জাতিক সাইকেল নেটওয়ার্ক বাইকস্-এর কলকাতার 'বাইসাইকেল মেয়র')

Powered by Froala Editor

More From Author See More