অপরিবর্তিত নিট-সহ অন্যান্য পরীক্ষার সূচি, করোনা আবহে কতটা যুক্তিযুক্ত এই সিদ্ধান্ত?

২০২০ সালের নিট এবং জেইই পরীক্ষা নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে বিরোধী দলগুলির তরজা থামার কোনও নামই নেই। বস্তুত, বিভিন্ন রাজ্যের অ-বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীদের থেকে শুরু করে কেন্দ্রের প্রধান বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরা কেন্দ্র এবং প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন এবারের পরীক্ষা স্থগিত রাখতে কিংবা পিছিয়ে দিতে। দেশজুড়ে এই বিতর্কের মধ্যেই ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি (এনটিএ) তাদের পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তেই অটল থাকার কথা ঘোষণা করে দিল। জেইই (মেন) এবং সর্বভারতীয় মেডিক্যাল (নিট) পরীক্ষার সূচি সেপ্টেম্বরের নির্ধারিত সময় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে এই সংস্থার তরফে।

কিন্তু কথা হচ্ছে সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতির মধ্যে যখন প্রতিদিনই বাড়ছে রোগে আক্রান্তের সংখ্যা, তখন কেন কেন্দ্র এই পরীক্ষা এখনই নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে? পরীক্ষা স্থগিত রাখার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছিল। যদিও পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার আবেদনের পিছনে সমস্ত যৌক্তিকতা খারিজ করে দিয়েছিল শীর্ষ আদালত। তারপরেই এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বার্তা রেখেছেন দেশের অন্যান্য নেতা-নেত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ছাত্র-ছাত্রীদের সুরক্ষা এবং জীবন আগে, নাকি পরীক্ষা সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ভেবে দেখতে বলার আর্জি এসেছে সকল ক্ষেত্র থেকেই। এরপরেও কেন্দ্রের তরফে কোনও হেলদোল দেখতে পাওয়া না যাওয়ায় এই কথা উঠতে তাই বাধ্য যে, সত্যিই কি পড়ুয়াদের ‘মন কি বাত’ বুঝতে সমর্থ কেন্দ্র?

বিভিন্ন স্তরে প্রশ্ন উঠছে বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন রীতিমতো ঝুঁকি নিয়েই চলাফেরা করতে হচ্ছে মানুষজনকে, দীর্ঘদিন লকডাউনের ফলে স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত হওয়ায় মানসিক ভাবেও সঠিক জায়গায় নেই অনেক ছাত্র-ছাত্রী, ব্যাহত হয়েছে পড়াশোনাও, সেই সময় তাদের জোর করে এই পরীক্ষায় বসতে বাধ্য করা কতটা যুক্তিযুক্ত হচ্ছে? যদি চলতি পরিস্থিতির শিকার হয়ে পরীক্ষায় বসতে না পারেন কেউ, তবে তাদের ভবিষ্যতের জন্য সেটা যে আরও বড় কোনও ক্ষতি ডেকে আনবে না, সেই ব্যাপারে কেন্দ্র নিশ্চিত তো? সুপ্রিম কোর্ট যদিও নিদান দিয়েছে অন্য দেশে থাকা যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী নেট পরীক্ষায় বসবেন, ‘বন্দে ভারত’ উড়ান প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের ফেরানোর ব্যবস্থা করুক কেন্দ্র। স্বাভাবিকভাবেই এই যুক্তিতেও বেঁধেছে বিতর্ক।

এরই মধ্যে বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে আরেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির সিদ্ধান্তেও। ইউইটি/পিইটি এন্ট্রান্স পরীক্ষার দিন হিসেবে পূর্ব নির্ধারিত আগস্টের ২৭ আর ৩১ তারিখকেই বহাল রাখার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হল ইমেলের মাধ্যমে পড়ুয়াদের। ঘটনাক্রমে, ওই দু’দিনই লকডাউন বাংলায়। সমস্ত সরকারি যানবাহন পরিষেবা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষার দিন পিছোতে না চাওয়ার এই সিদ্ধান্ত চোখে লাগার মতোই। ইমেলের ভাষাও আপত্তিজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরামর্শ, পরীক্ষার্থীরা নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়ি চড়ে পরীক্ষা দিতে আসতেই পারেন! অর্থাৎ নিজের গাড়ি না থাকলে অথবা বিত্তবান না হলে কি পড়া যাবে না বড় জায়গায়? প্রশ্ন কিন্তু উঠছে।

দেশজুড়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষোভ যে বাড়ছেই, তার প্রমাণও মিলেছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। এর মধ্যেই বিশ্ববন্দিত পরিবেশ কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ দেশজুড়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা স্থগিত করার জন্য প্রতিবাদ আন্দোলনে পাশে আছেন বলে যে বার্তা দিয়েছেন, তাতেও নতুন মাত্রা পেয়ে গেছে এই আন্দোলনের গতি। শুধুমাত্র করোনা পরিস্থিতি জন্যই নয়, দেশজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে বন্যার প্রকোপ বেড়ে চলেছে, তার মধ্যেই যদি এই সময়ে পরীক্ষা নেওয়া হয় তবে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন বহু ছাত্র-ছাত্রী, যারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে। এই প্রেক্ষিতে উচ্চশিক্ষা দিনে দিনে ‘এলিটিস্ট’ হয়ে পড়ছে কিনা, সেই বিষয়টা নিয়েও ভাবার সময় কিন্তু এসেছে।

যদিও কেন্দ্র আছে নিজের চালেই। যখন পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে দেশজুড়ে চলছে বিক্ষোভ, প্রতিবাদে-অনশনে সামিল হয়েছে পড়ুয়ারা, তখন পরীক্ষা নেওয়ার কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী কাঠগড়ায় তুলছেন সেই ছাত্র-ছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদেরকেই! শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক জানিয়েছেন, বাবা-মা এবং পড়ুয়াদের ক্রমাগত চাপের কারণেই বর্তমান পরিস্থিতিতেও নিতান্ত বাধ্য হয়েই পরীক্ষা নিতে হচ্ছে কেন্দ্র সরকারকে। ছাত্র-ছাত্রীদের চাপের কাছে মাথা নিচু করেই যে কেন্দ্রের পরীক্ষা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত, সেই বিষয়টি শুনতে অবাস্তব লাগা খুব স্বাভাবিক নয় কি? কারণ, দেশ জুড়ে ছাত্র-ছাত্রীদের এই বিপুল প্রতিবাদ কখনোই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সমর্থন করে না। তাই কেন্দ্র সত্যিই কতটা বাস্তবের জমিতে দাঁড়িয়ে এবং সহমর্মিতার সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির পর্যালোচনা করছে, তা কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় স্বাক্ষর হয়ে থাকতে চলেছে। এই পরীক্ষায় পাশ যদি করা যায়, তবে জিতবে সারা দেশ। সুরক্ষিত হবে ভবিষ্যৎও। দরকার শুধু বাস্তববোধ এবং প্রয়োজনীয় সদিচ্ছারও।

আরও পড়ুন
কর্মী ছাঁটাই-এর পর বেতনেও কোপ করোনার, দেশের গড় বেতন বৃদ্ধি কমল ৫.১ শতাংশ

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More