কারখানার দূষণে টকটকে লাল জল, প্রতিবাদে পথে উলুবেড়িয়ার পরিবেশকর্মীরা

“একসময় গুজারপুর খালে বহু মৎস্যজীবী মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আজকে এই খালে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। পাশাপাশি এই খালের দূষিত জল নালা কেটে চাষের জমিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে বিঘের পর বিঘে চাষের জমি নষ্ঠ হয়ে গেছে সম্পূর্ণভাবে।”

বলছিলেন পরিবেশকর্মী তথা মাধবপুর পরিবেশ চেতনা সমিতির সম্পাদক জয়িতা কুণ্ডু। এই প্রতিবেদনের শীর্ষের ছবিটি দেখলেই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে বিষয়টা। খালের জলের রং টকটকে লাল। কৃষি জমিকেও মুড়ে ফেলেছে লাল অধঃক্ষেপের আস্তরণ। উলুবেড়িয়া-১ (Ulueria) চণ্ডীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে গেলেই দেখা যাবে এই ভয়াবহ দৃশ্য। হ্যাঁ, রাসায়নিক দূষণের জেরেই এবার ধ্বংস হতে বসেছে সেখানকার বাস্তুতন্ত্র। নাজেহাল স্থানীয়রাও। 

এই দূষণের নেপথ্যে, উলুবেড়িয়ার মাধবপুর গ্রামে ১৬ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে অবস্থিত পিভিসি পাইপ তৈরির কারখানা (PVC Pipe Factory)। সমস্তরকম সতর্কতা নেওয়ার পরেও যে-কোনো কলকারখানা থেকেই অল্প-বিস্তর দূষণ ছড়িয়ে থাকে। তবে উলুবেড়িয়ার এই ঘটনা ছাড়িয়ে গেছে সমস্ত মাত্রাই। “কোনোরকম পরিশোধন না করেই দূষিত বর্জ্য জল সরাসরি গুজারপুর খালে নিষ্কাশন করছে এই কারখানা। পাশাপাশি নালা কেটে সেই জল ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে চাষের ক্ষেতেও”, জানালেন জয়িতা। তবে এখানেই শেষ নয়। এই খালের জল মিশছে দামোদর নদেও।

আরও পড়ুন
পরিবেশ সূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে সবার শেষে ভারত!

এই দূষণের জেরে বিগত কয়েক বছর ধরেই মাথায় হাত পড়েছে উলুবেড়িয়ার স্থানীয় কৃষক ও মৎস্যজীবীদের। একদিকে যেমন দূষণের জেরে বন্ধ হয়েছে চাষাবাদ, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বিঘের পর বিঘে জমির ফসল; তেমনই গুজারপুর খালের দূষিত জলে আজ মাছের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। দূষণের প্রভাব পড়ছে গবাদি পশুদের ওপরেও। চাষের ক্ষেতে জমে থাকা জল খাচ্ছে গরু, ছাগল ও অন্যান্য গবাদি পশুরা। ফলে তাদের মধ্যেও দেখা দিচ্ছে নানাধরনের রোগ। এমনকি স্থানীয়দের অভিযোগ, এই জল খেয়ে প্রাণও হারিয়েছে বেশ কিছু প্রাণী। 

আরও পড়ুন
অলিম্পিকের জন্য বৃক্ষনিধন, রুখলেন প্যারিসের পরিবেশকর্মীরা

আরও পড়ুন
ক্যানসার নিয়েও পরিবেশরক্ষার লড়াই, গোল্ডম্যান পুরস্কার মেক্সিকান তরুণীর

সাম্প্রতিক সময়ে আরও খানিকটা দীর্ঘ হয়েছে সমস্যার তালিকা। কারখানা থেকে প্রতিদিন অনিয়ন্ত্রিতভাবে নিষ্কাশিত করা হচ্ছে দূষিত ধোঁয়া। যার জেরে শীত-গ্রীষ্ম নির্বিশেষে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত গোটা অঞ্চলটাই মুড়ে থাকে গভীর ধোঁয়াশায়। এই অঞ্চলে হাজির হলেই টের পাওয়া যাবে ধোঁয়ার ঝাঁঝালো গন্ধ। গাছের পাতাতেও পড়েছে কালো আস্তরণ। শ্বাসকষ্টে ভুগছেন স্থানীয়রা। বিশেষভাবে অসুস্থ রোগীদের অবস্থায় হয়ে উঠছে আরও সঙ্গীণ। 

জয়িতা জানালেন, এর আগে সংশ্লিষ্ট কারখানা কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। তবে তাতে লাভ হয়নি কোনো। তাই এবার আন্দোলনের পথে হাঁটলেন তাঁরা। গত রবিবার এক অদ্ভুত দৃশ্যের সাক্ষী হয় উলুবেড়িয়ার মাধবপুর গ্রাম। মাধবপুর পরিবেশ চেতনা সমিতির উদ্যোগেই আয়োজিত হয় প্রতিবাদমূলক পদযাত্রা। সেইসঙ্গে কারখানা ঘিরে মানবপ্রাচীর গড়ে তোলেন পরিবেশকর্মীরা। বিশেষ করে মহিলা এবং খুদে ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতোই। 

“কারখানা বন্ধ হয়ে যাক, এটা আমরা চাই না। কারখানার ওপর বহু মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। তবে দূষণ নিয়ন্ত্রণে যাবতীয় প্রোটোকল সঠিকভাবে মানা হোক, এটাই আমাদের আবেদন”, বলছিলেন জয়িতা। ইতিমধ্যেই গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে ডেপুটেশন জমা দেওয়া হয়েছে সমস্ত প্রশাসনিক দপ্তরে। চিঠি পাঠানো হয়েছে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদেও। একমাত্র প্রশাসনের সক্রিয় উদ্যোগই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে এই পরিস্থিতিকে। সেদিকেই অসহায়ভাবে তাকিয়ে রয়েছেন মাধবপুরের সাধারণ মানুষরা…

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More