দেওয়া হল ইলেকট্রিক শকও, ব্রিটিশ পুলিশের নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্য হারালেন উল্লাসকর দত্ত

সালটা ১৯০৯। শুধু বাংলা নয়, গোটা ভারতের নানা জায়গায় আগুন জ্বলে উঠছে। সবার লক্ষ্য একটাই, স্বাধীনতা। ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে হবে। এমন সময় কলকাতাতে বিচার হচ্ছিল একটি মামলার। ‘বিখ্যাত’ এই মামলার শুনানির দিকে নজর ছিল প্রত্যেকের। যাকে বলে, হাই প্রোফাইল কেস। শহরেরই মুরারিপুকুরের একটি বাগানবাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল কয়েকজন যুবককে। তাঁরা বিপ্লবী। তাঁদের নিয়েই আলিপুর আদালতে চলছিল শুনানি।

ওই বিপ্লবীদের মধ্যে একজন ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। তিনি ছাড়া পেয়ে যান। বাকি যারা ছিলেন, তাঁদের কারোর ফাঁসি, কারোর দ্বীপান্তরের সাজা হয়। ১৯০৯ সালের ওই বিচারসভায় এই দলেরই একজনের ফাঁসি ঘোষণা করা হয়। যাকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হল, তিনি নির্বিকার চিত্তে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন কাঠগড়ায়। সাজা শোনার পরই নড়ে চড়ে বসলেন তিনি। বিচারকের সামনে একটি অনুরোধ রাখতে চান। কী সেই অনুরোধ? গান গাওয়ার। অনুমতি মিলতেই গলা ছেড়ে দিলেন বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত। ভরা আদালত কক্ষে তাঁর আশ্রয় হলেন রবি ঠাকুর; গাইতে লাগলেন, “সার্থক জনম আমার, জন্মেছি এই দেশে।”

গান-টান গাওয়ার পর বেশ খুশিমনেই জেলে ফিরে এলেন উল্লাসকর। যেন বেশ মজার একটা ব্যাপার ঘটেছে, এটা মনে করেই হাসতে লাগলেন তিনি। একসময় বলেও ফেললেন, “দায় থেকে বাঁচা গেল।” উল্লাসকরের এমন অবস্থা দেখে ইংরেজ প্রহরী ও অফিসাররা তো তাজ্জব! আজ বাদে কাল যার ফাঁসি হবে, সে কিনা খিলখিল করে হাসছে। তাঁর নাম যে উল্লাসকর দত্ত! একসময় ওই হাত ছিল বিপ্লবীদের ভরসা। বোমা বাঁধায় রীতিমতো দক্ষ ছিলেন তিনি। নিজেই ফর্মুলা বার করে বোমা তৈরি করতেন। তাঁর সঙ্গে জড়িত ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, নলিনীকান্ত গুপ্ত প্রমুখরা। ওপরে ওপরে পুলিশের নজর তো ছিলই। মুরারিপুকুরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করার পর আলিপুর বোমা মামলায় তাঁদের সাজাও হয়। সেখানেই ফাঁসি ঘোষণা হয় উল্লাসকর দত্তের।

এত তাড়াতাড়ি গল্প শেষ হবে না। উল্লাসকরের জীবন এখনও বাকি। ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল বটে, কিন্তু হয়নি। আপিল করার পর বারীন ঘোষ ও উল্লাসকর দত্ত— দুজনেরই প্রাণদণ্ড মকুব করে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা দেওয়া হয়। কলকাতার পাট চুকিয়ে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া আন্দামানের সেলুলার জেলে। সেটাই ছিল বিপ্লবীদের জেলখানা। সেইসঙ্গে ব্রিটিশদের অকথ্য অত্যাচারের ঠিকানা। এতে খানিক মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি। মৃত্যু তাও ঠিক ছিল; এখানে যে কী জীবনে কাটাতে হবে, কে জানে! এ যে সারাজীবনের মতো নরকবাস!

উল্লাসকর দত্ত কি নিজের বাকি জীবনটা দেখতে পেয়েছিলেন আগেই? এই প্রশ্ন কেউ করেছিল কিনা জানা যায়নি। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাঁর দ্বীপান্তরিত জীবনের যা বর্ণনা আছে, তা শুনলে গা শিউরে ওঠে। আন্দামানের সেলুলার জেলকে এমনি এমনি ‘কালাপানি’ বলা হত না। লোকমুখে সেখানকার বন্দি বিপ্লবীদের অবস্থা ছড়িয়ে পড়েছিল নানা জায়গায়। উল্লাসকর সেই অবস্থা ভোগ করলেন। প্রথমত, অমানুষিক খাটুনি; তার সঙ্গে অকথ্য অত্যাচার, শাস্তি— তাঁর জীবনকে নরক করে দেওয়া হয়েছিল এক প্রকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিশ্রাম না দিয়ে ঘানি টানানো, গাছ কেটে লাকড়ি বানানো, প্রচণ্ড রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে মাটি কেটে ইট তৈরির কাজ চলত। একটু দাঁড়িয়ে পড়লেই মোটা মোটা লাঠি, চাবুক দিয়ে পেটানো আরম্ভ হত। তাতেও না হলে, দু’হাত বেঁধে টেনে ঝুলিয়ে দেওয়া হত। তারপর চলত আরও নির্যাতন।

এই সমস্ত কিছুই উল্লাসকরকে পোহাতে হয়েছে। মানুষের শরীর ও মন একটা সময় পর্যন্ত সহ্য করে সব, তারপর ভাঙতে আরম্ভ করে। উল্লাসকরের ক্ষেত্রেও তাই হল। ইটের গোলায় কাজ করতে করতে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। আর কাজ করতে চাইলেন না। ডাক্তারও তাঁর অবস্থা দেখে চিন্তিত হল। কিন্তু ইংরেজরা তা শুনবে কেন? ওই অবস্থায় আবার উল্লাসকরকে পাঠানো হল ইটের গোলায়। শেষে অজ্ঞান হয়ে গেলেন তিনি। তারপর, সামান্য ভাতের মাড় খাইয়ে, সারারাত দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ডাক্তারের চেষ্টায় যখন জ্বর, শরীর খারাপ কমল, তখন উল্লাসকরের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলেন অন্য বিপ্লবীরা। শরীর ঠিক হলেও, মন একদম ভেঙে গিয়েছিল। সেই হাসিখুশি উল্লাসকর জড় পদার্থে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন।

অত্যাচার এখনও শেষ হয়নি। জেলের হাসপাতালে থাকাকালীন, একাধিকবার জোরালো ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয় তাঁকে। তাঁর নিজের বর্ণনায়, ‘‘সমস্ত শরীর বিদীর্ণ করিয়া, সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলীকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়া ঐ তড়িৎ নির্গত হইতে থাকে।” একসময় পাগল হয়ে যান তিনি। মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের। ১৯১৪ সালে আন্দামান থেকে মাদ্রাজের মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই বাকি চিকিৎসা করা হয় তাঁর।

১৯২০ সালে মুক্তি দেওয়া হয় বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তকে। আর ফিরতে পারেননি সক্রিয় বিপ্লবের ময়দানে। শরীর, মন— দুটোই তখন শেষ। উল্লাসকরের হাত যেমন পারত বাঁশিতে করুণ সুর তুলতে, সেই হাতই একের পর এক বোমা বাঁধার কাজ করে যেত। দুই জায়গাতেই তিনি ছিলেন শিল্পী। ১৯০৯ সালে ফাঁসি রদ হওয়ার খবর শোনার পর উল্লাসকর দত্ত হয়তো ঠিকই ভেবেছিলেন। ফাঁসি হলেই হয়ত ঠিক হত, পরবর্তী জীবনটা তো এমনিই ভেঙে দিয়েছিল চিরশত্রু ব্রিটিশরা। উল্লাসকর কি সত্যিই ভবিষ্যৎ দেখতে জানতেন!

ঋণ-
নির্বাসিতের আত্মকথা - উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
কারাজীবনী - উল্লাসকর দত্ত

Powered by Froala Editor

More From Author See More