হতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞানী, মাত্র ২২ বছরেই গুলিতে ঝাঁঝরা তরুণী পাইলটের স্বপ্ন

১৯৪৪ সালের এপ্রিল মাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়। ব্রিটেন-সোভিয়েত রাশিয়া-আমেরিকার মিলিত বাহিনী ক্রমশ কোণঠাসা করে ফেলছে হিটলার ও মুসোলিনিকে। রাশিয়ার বিমানবাহিনী রাতের অন্ধকারে ছারখার করে দিচ্ছে নাৎজিদের শিবির। এমন পরিস্থিতিতে বোমারু বিমান নিয়ে বেরিয়ে এলেন ২২ বছরের এক রুশ তরুণী— ইয়েভজেনিয়া রুডনেভা। সঙ্গে ছিলেন রেজিমেন্টে নতুন আসা আরেক পাইলট। এমন সময় নিচ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে এল গুলি। নাৎজিরা যেন অপেক্ষা করেই ছিল মুহূর্তটির জন্য। কোনোক্রমে বিমানটি নিয়ে বেরনোর চেষ্টা করলেন রুডনেভা; পারলেন না। ততক্ষণে সেই গুলি ঝাঁঝরা করে দিয়েছে তাঁকেও। মাত্র ২২ বছর বয়স। ক্রিমিয়ার কাছে যুদ্ধক্ষেত্রে এলিয়ে পড়লেন রুডনেভা। 

যুদ্ধে যে আসবেন, এমন স্বপ্ন কোনদিন ছিলও না ছোট্ট মেয়েটির। গ্রহ, নক্ষত্র নিয়ে মহাকাশের যে অসীম রহস্য, সেই দিকেই দুচোখ ভরে তাকিয়ে থাকতেন তিনি। দেখতেন কীভাবে উল্কা খসে পড়ছে। দূরবীন দিয়ে কীভাবে দূরের জিনিস কাছে চলে আসে। মহাকাশ নিয়েই এগোবে ভবিষ্যৎ, বিজ্ঞানী হবেন ইয়েভজেনিয়া— এমনটাই ভেবেছিলেন তাঁর বাবা-মা। কিন্তু চল্লিশের দশক সমস্ত কিছু বদলে দিল এক নিমেষে। বদলে দিল পৃথিবীর ছবিটা। আগুন জ্বলল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। 

১৯৪১ সাল। ২০ বছর বয়সী ইয়েভজেনিয়া রুডনেভা পড়াশোনা করছেন মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। পড়াশোনার পাশাপাশি লক্ষ্য করছেন চারিদিকের ছবি। যুদ্ধক্ষেত্রে হিটলার ও তাঁর নাৎজি বাহিনীর বিরুদ্ধে নেমেছে স্টালিনের লাল ফৌজও। প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে সেনারা। রুডনেভাও চাইলেন সেই দলে যোগ দিতে। পড়াশোনা তো আছেই; সেইসঙ্গে সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেও যদি দেশের হয়ে কিছু করতে পারেন… 

মনে রাখতে হবে, তখনও রাশিয়ার সামরিক বাহিনীতে মেয়েদের প্রবেশাধিকার ছিল না। সরাসরি লড়াইয়ের ময়দানে তাঁদের পাঠাতে রাজি ছিলেন না স্টালিনও। ১৯৪১ সালে অবস্থার বদল হল। রাশিয়ার মহিলা পাইলট মারিনা রাসকোভা নিজে গিয়ে স্টালিনকে একটি নারীবাহিনী গঠনের কথা বললেন। তারপরই বদলে গেল ছবিটা। আর এই বদলের শরিক হলেন ইয়েভজেনিয়া রুডনেভাও। যোগ দিলেন লাল ফৌজের নতুন তৈরি হওয়া মহিলা বিমানবাহিনীতে। মহাকাশচারী হওয়ার স্বপ্ন আপাতত পিছনে থাক… 

ইয়েভজেনিয়ার একটা নিয়মিত অভ্যাস ছিল ডায়েরি লেখার। লাল ফৌজের নতুন জীবনে পৌঁছেও সেই অভ্যাসে দাঁড়ি পড়েনি। সুন্দর করে, গুছিয়ে লিখে যেতেন পাতার পর পাতা। তাঁর জীবন, যুদ্ধের কাহিনি, স্বপ্ন সবকিছুই ফুটে উঠেছে সেখানে। পরবর্তীকালে সেই ডায়েরি বই হয়েও বেরিয়েছে। যাই হোক, বাহিনীর ভেতরেই তাঁদের শেখানো হয় কী করে বোমারু বিমান চালাতে হয়। ইয়েভজেনিয়া যেখানে যোগ দিয়েছিলেন, সেই নাইট বম্বার রেজিমেন্টের চরিত্রই সবার থেকে আলাদা করেছে তাকে। অন্যান্যদের অভিযান ছিল দিনের বেলায়, খটখটে রোদে। আর যখন তাদের কাজ শেষ হত, তখনই গোপনে শুরু হত নাইট বম্বারদের কাজ। নিঃশব্দে বিমান নিয়ে উড়ে যেতেন একের পর এক মহিলা নেভিগেটর। অন্ধকারে, সার্চ লাইটের আলো বাঁচিয়ে বোমা ফেলে দিতেন নাৎজি শিবিরে। সেই থেকে শত্রুপক্ষের কাছে তাঁদের নামই হয়ে যায় ‘নাইট উইচারস’…

আরও পড়ুন
এক দুপুরে নিশ্চিহ্ন সমস্ত বাসিন্দা, ফ্রান্সের এই শহরে লুকিয়ে বিশ্বযুদ্ধের নির্মম কাহিনি

আর সেই ‘নাইট উইচার’দেরই অন্যতম প্রধান ছিলেন ইয়েভজেনিয়া রুডনেভা। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪— দুই বছর ধরে একের পর এক নৈশ অভিযান সম্পন্ন করেছেন তিনি। আর সেটা করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। নাৎজিদের ভেতরে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। ডায়েরির পাতায় পাতায় ফুটে উঠেছে সেইসব গল্প। এক জায়গায় এসে ইয়েভজেনিয়া ভাবছেন তাঁর বাবার কথা। কলেজের বাকি মেয়েরা এতক্ষণে পড়াশোনা শেষ করে আরও বড়ো জায়গায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর তাঁর মেয়ে? যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। 

বহুদূরে, তাঁবুতে বসে সেই কথাই চিন্তা করতেন ইয়েভজেনিয়া। বয়স এসে দাঁড়িয়েছে বাইশের কোঠায়। শীতের রাতে এক একসময় ১৫-১৬টি অভিযান সেরে ফিরতেন তিনি। জীবন যেন হাতের মুঠোয়। কখন চলে যাবে, নিজেও জানেন না। এরই মধ্যে নাইট বম্বাররা গোটা রাশিয়ার কাছে নায়কের মর্যাদা পেয়েছিল। মেয়েদের এই দলটি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ইয়েভজেনিয়াদের দেখে নতুন মেয়েরাও ঢুকছে বাহিনীতে। এমনই একজনকে নিয়ে ১৯৪৪-এর এপ্রিলের রাতে উড়েছিলেন ইয়েভজেনিয়া। ভাগ্যের ফের! সেদিনই যে নিয়তি এসে ধরা দেবে তাঁর কাছে, কে জানত… 

২২ বছর বয়সে শেষ হয়ে গেল একটি ফুটফুটে জীবন। মহাকাশে বিচরণ করা আর হল না ইয়েভজেনিয়া রুডনেভার। যুদ্ধ শেষে একের পর এক মরণোত্তর সম্মান পেয়েছেন তিনি। তাঁর ডায়েরিও ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত জায়গায়। মহাকাশের একটি গ্রহাণুর নামকরণও করা হয়েছে ‘রুডনেভা’র নামে। আর তিনি? তখনও স্বপ্ন দেখে চলেছেন। ‘একদিন না একদিন তো এই যুদ্ধ শেষ হবে’…  

সূত্র- ‘The Soviet girl who fought the Nazis and became a star’, BBC

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
বুকে বিঁধেছে গুলি, তবুও সংবাদ পৌঁছে দিয়ে বিশ্বযুদ্ধে ২০০ সেনাকে বাঁচিয়েছিল এই পায়রা

More From Author See More