যুবসমাজকে সম্প্রীতি ও সাম্যের পাঠ দিয়ে দেশের সেরা সমাজকর্মী আশরাফ প্যাটেল

“অনেকসময় আমাকে শুনতে হয়, তোমার মতো বাকি মেয়েরাও কেন উদ্যোগপতি হয়ে আসছে না? কেন অন্ত্রেপ্রেনর হিসেবে ভারতবর্ষে মেয়েদের সংখ্যা এত কম? কিন্তু আমার মতে, ব্যাপারটা ছেলে কিংবা মেয়ে নয়; ব্যাপারটা হল সমতা। সমাজের বাকি অংশের মতো একটি মেয়েরও এটি অধিকার। সমস্ত জায়গায় এটা নিয়ে কথা বলার দরকার। সবথেকে বেশি কথা বলা দরকার মেয়েদেরই। তাহলেই পরিস্থিতি বদলাবে।”

প্রহরকে বলছিলেন আশরাফ প্যাটেল। সেই নব্বইয়ের দশক থেকে তাঁর কাজ ভারতের প্রতিটি কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ছে। আশরাফের সঙ্গে এই রাস্তায় হাজির হয়েছে তাঁরই দুটি সংস্থা— প্রভা এবং কমমিউটিনি। ভারতের যুব সম্প্রদায়, যাঁদের ওপর দেশের আশা, ভরসা; যারা এই দেশের মেরুদণ্ড তাঁদের নিয়েই তিনি কাজ করছেন। তুলে আনছেন নতুন নতুন উদ্যোগপতি ও সমাজকর্মীদের। সম্প্রতি তারই স্বীকৃতি পেলেন আশরাফ প্যাটেল। ২০২০ সালের ‘সোশ্যাল অন্ত্রেপ্রেনর অফ দ্য ইয়ার’ পেলেন তিনি। এই পুরস্কার কি একান্ত তাঁর? নাকি আশরাফ এবং তাঁর সংস্থার ভাবাদর্শের? 

“আমাদের কাজের মূল ভিত্তিই হল ভারতের যুবসমাজ। তাঁদের কাজ, তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে আরও অবহিত করাই অন্যতম কাজ। শুধু একটি অঞ্চল, বা একটি দেশ হিসেবে নয়; গোটা পৃথিবীর জন্য এটি প্রয়োজনীয়। আর এই কাজটি তখনই হবে যখন কেবল যুবকেরা নন; আমরা প্রত্যেকে এগিয়ে আসব। আমাদের সবাইকে মিলে সেই পরিবেশটা তৈরি করতে হবে। যদি সবাই মিলে সেই জায়গাটা তৈরি করতে পারি, তাহলেই সমাজের তরুণ রক্ত নিজেদের সামর্থ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে আসবে। আর তাঁরা এগিয়ে আসলে সবাই এগিয়ে যাবে।” সোশ্যাল অন্ত্রেপ্রেনর অফ দ্য ইয়ারের পুরস্কারটি পাওয়ার পর এমন কথাই বলেছিলেন আশরাফ। একটু একটু করে ছুঁয়ে যাচ্ছিলেন নিজের যাত্রার কথা। ছুঁয়ে যাচ্ছিলেন নিজের সহযোদ্ধাদের; যারা না থাকলে হয়তো ‘প্রভা’ এবং ‘কমমিউটিনি’র ছবিটাই তৈরি হত না… 

আরও পড়ুন
একই অট্টালিকায় গুরুদুয়ার-মন্দির-গির্জা-মসজিদ, সম্প্রীতির দৃশ্য উত্তরপ্রদেশের লাইব্রেরিতে

১৯৯২ সাল। ভারতের ইতিহাস এবং রাজনীতি কখনও ভুলবে না এই বিশেষ সালটিকে। এটি সেই সময়, যখন বাবরি মসজিদকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কেবল উত্তরপ্রদেশই নয়; গোটা ভারত তখন অদ্ভুত এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। মানুষের চোখে মুখে অবিশ্বাস ঢুকে যাচ্ছে; পাশে বসে থাকা ভিনধর্মের বন্ধুটিকেও ভরসা হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতির সামনে দিয়ে এসেছেন আশরাফ। “বাবরির ঘটনার পর গোটা দেশে হিংসা ছড়িয়ে পড়ছিল ভয়ংকরভাবে। আমাদের চারিদিকটাও বদলে যাচ্ছিল। তখন আমাদের মাথায় এল কিছু একটা করা দরকার। আমরা স্কুলে গিয়ে, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে, যুব সম্প্রদায়কে বোঝাতে লাগলাম যে এই হিংসা শুধুমাত্র সমাজের বাইরেই হচ্ছে না। আমাদের ভেতরেও হচ্ছে, আমরা পুষে রেখেছি এসব। এগুলোকে দূরে সরাতে হবে। আমার সঙ্গে আরও দুজন বন্ধু ছিলেন। সবাই মিলে একটা ওয়ার্কশপ শুরু করলাম— ‘পজিটিভ মি’। পরবর্তীকালে এর নাম বদলে রাখা হয় ‘ফ্রম মি টু উই’। সবাইকে এই হিংসা থেকে দূরে সরাতে হবে, এটাই ছিল লক্ষ্য”, বলছিলেন আশরাফ। 

আরও পড়ুন
মুসলমান কারিগরদের হাতেই ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ হিন্দু দেবদেবীর; কলকাতায় সম্প্রীতির ঐতিহ্য এমনই

এখান থেকেই যাত্রা শুরু ‘প্রভা’র। ১৯৯৩ সালে আশরাফ প্যাটেল, অর্জুন শেখর, মিনু ভেঙ্কটেশ্বরন— তিন বন্ধু মিলে এই সংগঠন শুরু করেন আশরাফ প্যাটেল। “আমরা চেয়েছিলাম, এই কাজ কেবল ক্লাসরুমে আটকে না রেখে সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে দিতে। এর জন্য সবাইকে এক ছাতার তলায় এনে আমরা এগোতে চাইছিলাম। সেখান থেকে প্রভার শুরু।” সেই ১৯৯৩ থেকে আজ অবধি ভারতের বহু তরুণ উদ্যোগপতির সঙ্গে কাজ করেছেন আশরাফরা। তাঁদের সহায় হয়েছেন, একসঙ্গে কাজ করেছেন, পৌঁছে গেছেন ঘরে ঘরে। সে রূপান্তরকামী মানুষদের নিয়ে কাজই হোক, বা পরিযায়ী শ্রমিক, কৃষক, পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য কাজ— সব জায়গায় তরুণ-তরুণীদের পাশে এগিয়ে এসেছে ‘প্রভা’। শুধু নিজে নয়, আরও বহু সংস্থার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে চলছে এই বিরাট কর্মযজ্ঞ। আশরাফ প্যাটেল এবং তাঁর সংস্থার সঙ্গে উঠে আসছে আরও নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান। প্রত্যেকেই কাজ করছেন সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে। কেউ শহরে, কেউ আবার পৌঁছে যাচ্ছেন প্রত্যন্ত গ্রামে। কিন্তু মূল মন্ত্র একটাই- ‘আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি’… 

আরও পড়ুন
মুম্বাই থেকে বাংলায় নিয়ে এসেছিলেন মনজিনিস, ক্যানসারের কাছে হার মানলেন বাঙালি উদ্যোগপতি

প্রায় একই লক্ষ্য নিয়ে ২০০৮ সালে যাত্রা শুরু করে আশরাফের আরও একটি সংস্থা ‘কমমিউটিনি’। লক্ষ্য, সমস্ত যুব অন্ত্রেপ্রেনরদের এক করে একটা বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তন। পুরস্কার পাওয়ার পর আশরাফ যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেখানে তিনটে শব্দের খুব জোরালো উপস্থিতি ছিল। ‘Environment’ অর্থাৎ পরিবেশ, ‘Conflict’ অর্থাৎ দ্বন্দ্ব, ‘Inequality’ অর্থাৎ অসাম্য। এই তিনটে দিকের সঙ্গেই জুড়ে আছে আশরাফের ভাবনা। “আমরা সরাসরি এইসব বিষয় নিয়ে কাজ করি না। এগুলো তো শুধু ভারতের নয়; গোটা বিশ্বের সমস্যা। আমরা চেষ্টা করি, আমাদের যুবসমাজ যাতে নিজেদের চিনতে পারে, নিজেদের ক্ষমতাকে চিনতে পারে, এবং সেইসঙ্গে নিজের সমাজকেও গভীরভাবে দেখতে পারে। সেখানকার সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবতে পারে। শুধু নিজের জন্য নয়, আরও অনেকের জন্য কাজ করা। আমরা চেষ্টা করি এরকম তরুণ উদ্যোগপতিদের পাশে দাঁড়াতে, যাতে তাঁদের দেখে আরও অনেকে উঠে আসে। এইভাবেই তো একটা কাঠামো তৈরি হয়। আমাদের ভাবনায় বদল আসে। আর তাঁরা একসঙ্গে কাজ করলে এই পৃথিবীরই লাভ। ধরুন, কেউ আসামে কাজ করছেন, কেউ ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত গ্রামে; কেউ আবার কলকাতা, দিল্লির মতো শহরে। সব মিলিয়ে এটা একটা বৃহত্তর গোষ্ঠী। প্রভা আর কমমিউটিনি সেই গোষ্ঠীরই একটা অংশ”, বলছিলেন আশরাফ প্যাটেল। 

আরও পড়ুন
স্বনির্ভরতাই যথেষ্ট নয়, উদ্যোগপতি হয়ে উঠুক গ্রামের মেয়েরা - অন্যরকম লড়াই শিবানীর

প্রতিটা কথা বলার সঙ্গে তৈরি হচ্ছিল আন্তরিকতা। তৈরি হচ্ছিল একটা স্বপ্নের গল্প, আর আত্মবিশ্বাস। এই আত্মবিশ্বাসই বোধহয় আমাদের আরও দূরে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সামনে এখনও অনেক কাজ। সোশ্যাল অন্ত্রেপ্রেনর অফ দ্য ইয়ারের পুরস্কার পাওয়ার পর আরও বড়ো ছবি দেখতে শুরু করেছেন আশরাফ প্যাটেল। আরও আরও মানুষের কাছে পৌঁছতে চান তিনি। আরও যুবশক্তি যাতে উঠে আসে নিজেদের ক্ষমতা নিয়ে, সেটাই তিনি চান। আর তাঁদের হাত ধরার জন্য সর্বক্ষণ আছেন তিনি। আসলে আমরা সবাই তো একসূত্রে বাঁধা!

Powered by Froala Editor