স্থায়িত্ব মাত্র ৪৫ মিনিট, পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম যুদ্ধেরও পরিণতি ভয়াবহ

‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’— কথাটা প্রায় প্রবাদবাক্যের হয়ে উঠেছে বাংলা ভাষায়। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস। কিন্তু কখনো কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেও পরাক্রমী প্রতিপক্ষের কাছে রণে ভঙ্গ দিলে হয়তো এড়ানো যায় বড়ো ক্ষয়ক্ষতি। বছরের পর বছর যুদ্ধ চলার পর, সর্বস্বান্ত হওয়ার পর তা বুঝতে পারে কেউ। কেউ আবার এই কঠিন বাস্তবতার উপলব্ধি করতে পারেন দ্রুত। যেমনটা ঘটেছিল অ্যাংলো-জাঞ্জিবার যুদ্ধের (Anglo-Zanzibar War) ক্ষেত্রে। আজ থেকে প্রায় ১২৫ বছর আগের কথা। ব্রিটিশ শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে এক ঘণ্টার মধ্যেই আত্মসমর্পণ করেছিলেন জাঞ্জিবার-সম্রাট। 

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র এক ঘণ্টা। আরও ভালো করে বলতে গেলে ৪৫ মিনিট। পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের গড় সময়সীমার কাছেও যা ক্ষুদ্রতর। আর সেই কারণেই বিশ্বের ইতিহাসের সর্বকালীন ক্ষুদ্রতম যুদ্ধ (Shortest War) হিসাবেই বিবেচিত হয় এই যুদ্ধ। কিন্তু কোন ঘটনা চালিত করেছিল এই সংঘর্ষকে? তার ক্ষণস্থায়িত্বেরই বা কারণ কী? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হবে ১৩০ বছর।

উনিশ শতকের শেষ দিক সেটা। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ততদিনে উপনিবেশ স্থাপন করে ফেলেছে ব্রিটিশরা। জাঞ্জিবার দ্বীপেও অন্যথা হয়নি তার। ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে জাঞ্জিবার সুলতানের মধ্যে দ্বৈত সরকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আর তারপর থেকে সিংহাসনে সুলতান থাকলেও, প্রশাসনিক কার্যকলাপ থেকে শুরু করে সামরিক বিভাগ সবটারই নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রিটিশদের হাতে। 

বছর ছয়েক এভাবেই নির্বিঘ্নে চলেছিল জাঞ্জিবারের শাসন ব্যবস্থা। কিন্তু সমস্যা বাঁধে ১৮৯৬ সালে। তখন সুলতানের সিংহাসনে রয়েছেন হামাদ বিন থুওয়ানি। ’৯৬ সালের ২৫ আগস্ট অপ্রত্যাশিতভাবেই মারা যান তিনি। আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে সুলতান হিসাবে ঘোষণা করেন তাঁর খুড়তুতো ভাই খালিদ বিন বারগাশ। ব্রিটিশ আধিকারিকদের তদন্তে উঠে আসে হামাদ বিন থুওয়ানিকে খাবারের সঙ্গে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। হাতেনাতে তার প্রমাণ মিললেও, সিংহাসন ছাড়তে অস্বীকার করেন বিন বারগাশ।

আরও পড়ুন
সোভিয়েত পতনের পরেও শেষ হয়নি ঠান্ডা যুদ্ধ, নতুন করে শুরু প্রস্তুতি


আরও পড়ুন
শের শাহের মতোই প্রবল বিক্রমে লড়াই, কার্গিল যুদ্ধের নায়ক বিক্রম বাটরা

অন্যদিকে বিন বারগাশের স্বঘোষিত সিংহাসনলাভের কথা রীতিমতো চিন্তায় ফেলে দেয় লন্ডনকেও। কেননা, চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদন ছাড়া সুলতান বদল নিয়ম বহির্ভূত। পাশাপাশি স্বঘোষিত সুলতানের শাসনে সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল প্রবল। এতএব ব্রিটেন থেকে সতর্কবার্তা পৌঁছাল জাঞ্জিবারের রাজপ্রাসাদে। ২৭ আগস্ট সকাল ৯টার মধ্যে খালিদ সিংহাসন না ছাড়লে যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে তার বিরুদ্ধে। 

আরও পড়ুন
মারাঠাদের দমন করতে বিশাল আফগান সৈন্য, ভয়ংকর সেই যুদ্ধের পরিণতি কী?

তবে এই সাবধানবাণীতে লাভ হয়নি কিছু। উল্টে রীতিমতো যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দেন সুলতান খালিদ। রাজপ্রাসাদ রক্ষার জন্য মোতায়েন করেন ২৮০০ সেনা। যার অধিকাংশই ছিল সাধারণ নাগরিক। যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা তো দূরের কথা, প্রশিক্ষণটুকুও ছিল না যাঁদের। বিপক্ষে ব্রিটিশ বাহিনী হাজির হয়েছিল তিনটি ক্রুজার, গানবোট এবং ১৫০ মেরিন নিয়ে। ৯০০ জাঞ্জি সেনাও সেদিন লড়েছিল ব্রিটিশদের পক্ষে। ফলত, যুদ্ধের ফলাফল এক কথায় আগে থেকেই যেন নির্ধারিত ছিল। 

ঘড়ির কাঁটায় ৯টা বাজার ঠিক দু’মিনিটের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় ধুন্ধুমার সংঘর্ষ। রয়্যাল নেভির শেলের আঘাতে বিধ্বস্ত হয় রাজপ্রাসাদের একাংশ। অন্যদিকে আর্টিলারি, মেশিনগান নিয়ে লড়াই শুরু করলেও, পাল্লা দিয়ে উঠতে পারেনি সুলতানের সেনাবাহিনী। কেবলমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল স্কটিশ বাহিনী দুটি ছোটো নৌকা। তবে মাত্র আধঘণ্টার মধ্যেই প্রাণ হারান জাঞ্জিবারের ৫০০ সেনা।

অবস্থা ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে যুদ্ধের ঠিক ৪৫ মিনিটের মাথায় রণেভঙ্গ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সুলতান খালিদ। প্রাসাদের মাথা থেকে নামিয়ে আনা হয় জাঞ্জিবারের পতাকা। পলাতক হয়ে জার্মানির আশ্রয় নেন সুলতান খালিদ। না, তাঁকে সে-সময় বাগে পায়নি ব্রিটিশ শক্তি। ১৯১৬ সালে বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় তাঁকে বন্দি করে রয়্যাল আর্মি। মোম্বাসায় নির্বাসনে পাঠানো হয় তাঁকে। সেখানেই ১৯২৭ সালে মৃত্যু হয় খালিদ বিন বারঘাসের।

তবে সুলতান পালিয়ে গেলেও, যুদ্ধের পর সেবার গুনে গুনে মাশুল দিতে হয়েছিল দ্বীপরাষ্ট্রটিকে। ক্ষয়ক্ষতি তো হয়েছিলই, উল্টে যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর খরচ হওয়া আর্টিলারি এবং সেলের দাম দিতে হয়েছিল জাঞ্জিবারের নতুন সম্রাটকে। যার মূল্য তৎকালীন সময়ে ধার্য করা হয়েছিল ৩ লক্ষ টাকা। সবমিলিয়ে মাত্র ৪৫ মিনিট স্থায়ী হলেও ক্ষুদ্রতম এই যুদ্ধ যে ধারে-ভারে রীতিমতো ভয়ঙ্কর ছিল, তা বলার অপেক্ষা থাকে না…

Powered by Froala Editor