মারাঠাদের দমন করতে বিশাল আফগান সৈন্য, ভয়ংকর সেই যুদ্ধের পরিণতি কী?

যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি হতে চলেছে যুযুধান দুই পক্ষ। একদিকে বাগপথে আফগান শিবিরে শেষ মারণ কামড় দেওয়ার প্রস্তুতি। অন্যদিকে কুঞ্জপুর দুর্গে মারাঠাদের মধ্যেও আনন্দের রেশ দেখা দিয়েছে। এবারের যুদ্ধে তাঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন ইব্রাহিম কার্দি। তাঁর মতো কামান চালাতে খুব কম সৈনিকই জানেন। ফলে এবারের যুদ্ধেও যে মারাঠারা প্রথম থেকেই এগিয়ে থাকবেন, সেটা ধরেই নিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস হয়তো কোনোদিনই গণিতের সূত্র মেনে চলেনি। আর যুদ্ধের ইতিহাস তো নয়ই। সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার মরণপণ লড়াইয় তো রয়েছেই। এছাড়া যুদ্ধ মানে অবশ্যই বিশ্বাসঘাতকতারও ইতিহাস। সবদিক মিলিয়েই পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ ভারতের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। ১৯৬১ সালের এই যুদ্ধকে এদেশের ঔপনিবেশিক ইতিহাসের শুরু বললেও হয়তো খুব ভুল হয় না।

একদিকে প্রথম আফগান শাসক আহমদ শাহ আবদালি। সঙ্গে তাঁর বিপুল সেনাবাহিনী। কান্দাহার থেকে সিন্ধুদেশের সমস্ত মুসলমান শাসক তাঁর শিবিরে। মারাঠা দমনের প্রতিশ্রুতি পেয়ে শিবিরে যোগ দিয়েছেন মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম। আহমদ শাহের শিবিরে রয়েছেন অযোধ্যার শাসকও। অন্যদিকে মারাঠা শিবিরে মিত্রশক্তি অল্পই। কয়েকটি রাজপুত পরিবার এবং জাঠরা যোগ দিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে। তবে রয়েছেন সদাশিব রাওয়ের মতো দক্ষ নেতা। স্বয়ং শিবাজী মহারাজের সবচেয়ে কাছের পারিষদ সদাশিব রাও। তাঁর কূটবুদ্ধির কাছে বারবার হারতে হয়েছে শত্রুপক্ষকে। জীবনের শেষ যুদ্ধেও সবটুকু দিয়ে লড়াই করে গিয়েছেন সদাশিব রাও। প্রবল পরাক্রমের সঙ্গে আহমদ শাহের বাহিনীকে রুখে দিয়েছিলেন তাই নয়, একের পর এক জায়গা দখলও করে নিয়েছিল মারাঠা বাহিনী। তবে শেষ মুহূর্তে মিত্র জাঠ বাহিনী বিশ্বাসঘাতকতা করে। বদলে যায় যুদ্ধের সমীকরণ। নাহলে হয়তো ভারতের ইতিহাসটাই অন্যরকম হত।

আহমদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণ অবশ্য এই প্রথম নয়। ১৯৩৯ সাল থেকে সব মিলিয়ে ৮ বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন তিনি। প্রথমবার নাদির শাহের বন্দি সৈনিক হিসাবে এসেছিলেন মোঘল সাম্রাজ্য আক্রমণে। এই সময়েই ময়ূর সিংহাসন এবং কোহিনূর লুঠ করে নিয়ে যান নাদির শাহ। সেই যুদ্ধেই মোঘল সাম্রাজ্যের সমস্ত খুঁটিনাটি বুঝে নিয়েছিলেন আহমদ শাহ। ১৭৪৮ সালে প্রথমবার এককভাবে মোঘল সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন আহমদ শাহ। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেদিন মোঘল সম্রাটের পাশে দাঁড়িয়েছিল মোঘল বিরোধী দুই শক্তি মারাঠা এবং শিখ। ১৭৫২ এবং ১৭৫৬ সালে পরপর দুবার আক্রমণ করে ভারতের  বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করতে পেরেছিলেন আহমদ শাহ। কিন্তু মারাঠাদের কাছে বারবার হারতে হয়েছে তাঁকে। তাই এবার সর্বশক্তি দিয়ে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলেন তিনি।

যুদ্ধের ইতিহাস হয়তো বন্ধুত্বের স্মৃতি মনে রাখে না কোনোদিনই। তাই আহমদ শাহের মৈত্রীচুক্তি পেয়ে এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন দ্বিতীয় শাহ আলম। মারাঠা বিদ্রোহের জেরে তাঁর সাম্রাজ্য তখন যথেষ্ট বেকায়দায়, এ-কথা সত্যি। তবু পূর্ববর্তী দুই যুদ্ধে মারাঠাদের সাহায্যের স্মৃতি এত সহজে আবছা হয়ে যাওয়া অবাক করে। সদাশিব রাও অবশ্য এমন বিশ্বাসভঙ্গের সঙ্গে পরিচিত। তিনি সময় নষ্ট না করে জোট গড়ে তুলতে চেষ্টা করলেন। সৈন্যসংখ্যা সামান্যই। কিন্তু মারাঠা ঐতিহ্য রক্ষা করতে সকলেই প্রাণ দিতে প্রস্তুত। সমসাময়িক বেশ কিছু ইউরোপীয়ের বিবরণ থেকে জানা যায়, একদিনের যুদ্ধে অন্তত এক লক্ষ মারাঠা সেনার মৃত্যু হয় যুদ্ধের ময়দানে। তবে মারাঠারা প্রথম ধাক্কাতেই দিল্লির বেশ কিছুটা অংশ দখল করে নিতে পেরেছিল।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য আহমদ শাহকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। বিশ্বাসঘাতক জাঠ নেতা দত্তজি সিন্ধের নেতৃত্বে প্রথম জয়ের স্বাদ পেল আফগান বাহিনী। এরপর একটু একটু করে তাঁদের দিকে জয়ের পাল্লা ভারী হতে থাকল। প্রায় এক বছর ধরে বিক্ষিপ্ত নানা সংঘর্ষের পর অবশেষে এল পানিপথের অন্তিম যুদ্ধের দিন। মারাঠা শক্তি ততদিনে ক্ষীণ। তবু পরাজয় স্বীকার করে নিতে রাজি নন কেউই। যুদ্ধের ইতিহাসে হয়তো কিছুই অসম্ভব নয়। অবস্থা বেগতিক দেখে তখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়েছেন মারাঠা কম্যান্ডো সদাশিব রাও স্বয়ং। অবশ্য প্রাণে বাঁচতে পারেননি। সদাশিব রাওয়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই যুদ্ধ শেষ ঘোষণা করেন আহমদ শাহ। যুদ্ধে জড়িত প্রতিটা শক্তিকে চিঠি লিখে তিনি জানান, আসলে ভারত দখল করতে আসেননি তিনি। এসেছিলেন মারাঠাদের দমন করতে। সেই কাজে তিনি সফল হয়েছেন। মারাঠা শক্তির সঙ্গেও তাঁর আর কোনো শত্রুতা নেই বলে জানিয়ে দেন আহোমোড। যে শক্তি যেমনভাবে রাজত্ব চালাচ্ছিল, সেভাবেই চালাবে। শুধু যুদ্ধের স্বীকৃতি বাবদ পাঞ্জাব অংশের কর্তৃত্ব চাইলেন আহমদ শাহ। তবে শিখদের দমন করা সম্ভব হয়নি আহমদ শাহের পক্ষেও। এরপর আরও দুটি যুদ্ধে শিখদের কাছে হারতে হয়েছিল তাঁকে। তবে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।

পাণিপথের তৃতীয় যুদ্ধ হয়তো ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে বিশেষ কিছু পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। কিন্তু ব্রিটিশ শক্তি তখন একেবারে কাছ থেকে দেখেছিল ভারতের প্রতিটা রাজনৈতিক শক্তির দুর্বল জায়গাগুলো। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই পরপর প্রতিটা শক্তিকে কব্জা করতে পেরেছিল তাঁরা। ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের শুরুটা তাই অস্পষ্ট থেকে যায় পাণিপথের তৃতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব না বুঝলে। প্রায় দুই শতাব্দীর ব্রিটিশ আধিপত্যের সঙ্গে তাই জড়িয়ে গিয়েছে আফগানিস্তানের ইতিহাসও।

Powered by Froala Editor

More From Author See More