বড়ো নামে আপত্তি, ইংরেজ সাহেবের কথায় ‘মণিশংকর’ হয়ে গেলেন ‘শংকর’

পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিক। ইংরেজ শাসন শেষ হয়ে গেলেও, তখনও ভারত ছাড়েননি সাহেবরা। কলকাতাও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানকারই হাইকোর্টে তখন ওকালতি করছেন এক ইংরেজ ব্যারিস্টার— নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েল। ইতিহাস বলে দেবে, ইনিই ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টার। এই পরিবারের একটি ঐতিহ্য আছে, ইতিহাস আছে। যাই হোক, সেই নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েলের কাছে হাজির হলেন এক বাঙালি তরুণ। সাহেবের অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে শুরু করলেন কাজ। তবে সে তো কেবল পকেটের জন্য; ভেতরের স্বপ্ন যে অন্য। তরুণটি লিখতে চান। কিন্তু সাহেব বেশ অসুবিধাতেই পড়লেন প্রথমে। না, লেখালেখি নিয়ে নয়; ছোকরার নাম নিয়ে। এত বিশাল একটি বাঙালি নাম, উচ্চারণ করবেন কী করে! অতএব, ছোটো হল নাম। সেদিন থেকেই, ‘মণিশংকর মুখোপাধ্যায়’ হয়ে গেলেন ‘শংকর’…

এই হাইকোর্টের কেরানির জীবন, সেখানকার পরিবেশ, চেনা-অচেনা মানুষ ও কলকাতা— এই সবকিছু একটু একটু করে দেখছিলেন শংকর। দেখছেন, আর এগোচ্ছেন। ১৯৫৩ সাল। ঠিক করলেন, যা ঘটছে চারপাশে সেখান থেকেই উপাদান নিয়ে শুরু করবেন লেখা। শংকরের বয়স তখন সবে উনিশ কি কুড়ি। শুরু হল ‘কত অজানারে’ লেখার কাজ। বারওয়েল সাহেব, তাঁর জীবনের গল্প, হাইকোর্টের দৃশ্য এবং সেখানকার গল্প— সব নিয়ে তৈরি হল একটা উপাখ্যান। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ, এবং ১৯৫৫ সালে বইয়ের আকারে প্রকাশ পেল ‘কত অজানারে’। প্রথম বইতেই বাজিমাত। সাহিত্যমহলে সদর্পে পা রাখলেন শংকর। শুরু হল এক মহাযাত্রার… 

তাঁর জীবন বারবার বাঁক বদল করেছে। নানা সময় নানা জীবিকার খাঁচায় জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। দেশভাগের আগেই যশোর ছেড়ে চলে আসা এপারে; সংসারের প্রয়োজনে সেই অল্প বয়স থেকেই কাজে নেমে পড়তে হয়েছে। জীবন যত এগিয়েছে, ততই অভিজ্ঞতার ঝুলিও ভারী হয়েছে। আর এই অভিজ্ঞতাই শংকরের অন্যতম প্রধান সম্বল। তখন ইস্টার্ন রেলওয়েতে চাকরি করছেন তিনি। সেখানেই আলাপ সত্যসুন্দর বসু’র সঙ্গে। ভদ্রলোক রেলওয়ের এক অফিসার; কিন্তু বেশ স্মার্ট একটা ব্যাপার আছে তাঁর মধ্যে। সাহেবদের সঙ্গে মিশে ইংরেজিটা ভালোই রপ্ত করেছিলেন। অনেক সময়ই নিজের নাম বদলে দিতেন তিনি। মজা করে বলতেন ‘স্যাটা বোস’। এই ঘটনা মনে থেকে গিয়েছিল শংকরের। পরবর্তীকালে ‘চৌরঙ্গী’র দৌলতে গোটা বাংলার আপনজন হয়ে যান সেই ‘স্যাটা বোস’। বইয়ের পাতা থেকে পর্দায় উত্তমকুমার— সবকিছু সরিয়ে শংকরের জীবনে বারবার উঁকি দিয়ে যান বাস্তবের সত্যসুন্দর ‘স্যাটা’ বোস… 

তখন ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাস শুরু করবেন। কিন্তু কীভাবে করবেন বুঝতে পারছেন না। মধ্যবিত্ত পরিবার, কোনদিন বড়ো হোটেলে যাননি। কিন্তু ঠিক করেছেন, হোটেল নিয়ে বই লিখবেন। কথায় কথায় একদিন এমনটা জানালেন অমিয় চক্রবর্তীকে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। কলকাতার হোটেল নিয়ে বই লিখবে, অথচ সেখানকার জীবন দেখবে না, জানবে না তা হয় নাকি? যদি ভুলভাল লিখে ফেলে, তাহলে তো বদনাম হয়ে যাবে! সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিলেন অমিয় চক্রবর্তী। পরবর্তী দুই বছর, শংকর যে যে হোটেল, বারে যেতে চান সেখানে বিনা বাধায় যাবেন। কেউ কিচ্ছু বলবে না। কোনো খরচও লাগবে না। ‘চৌরঙ্গী’ লেখার জন্য যা যা করার দরকার, সব করবেন শংকর। 

ব্যস, এমন সাহায্য চলে এলে তো থেমে থাকতে নেই। গ্র্যান্ড, গ্রেট ইস্টার্ন, স্পেনসেস— শংকরের হাত ধরে কলকাতা চিনল তার আরও একটি সত্তাকে। বাকিটা নিশ্চয়ই নতুন করে বলে দিতে হবে না। ২০১২ সাল পর্যন্ত যে উপন্যাসের ১১১টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে, সেটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নতুন করে সন্দেহ ওঠারই কথা নয়। সেই সময় প্রশংসাও এসেছে, সঙ্গে নিন্দাও। কিন্তু ‘চৌরঙ্গী’ এড়িয়ে কি যাওয়া যায়? আর শংকর স্বয়ং? বড়ো বড়ো সাহিত্যের আসর এড়িয়ে গেছেন সবসময়। নেই বড়ো কোনো পুরস্কার; কেবল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.লিট, এবং ২০১৯-এ কলকাতার শেরিফ হওয়া। কেবল ‘চৌরঙ্গী’ই নয়, ‘জন অরণ্য’, ‘সীমাবদ্ধ’ও বড়ো পর্দায় এসেছে সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে। ‘বোধোদয়’ উপন্যাস লেখার পর প্রাণভরে উৎসাহ দিয়েছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ওহ, অনেক সাক্ষাৎকারে এসবের বাইরে আরও একটি পুরস্কারের কথাও বলেছেন। ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসের জন্য শ্রেষ্ঠ বাইন্ডিংয়ের পুরস্কার! শংকর এমনই। সবার ঘরের মানুষ, অথচ নিজের রাস্তায় একা। চৌরঙ্গী’র মতোই…        

তথ্যসূত্র-
১) ‘জীবনটাই তো একটা চৌরঙ্গী’, সাক্ষাৎকার শংকর, গৌতম ভট্টাচার্য
২) ‘‘কত অজানারে’: বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী ক্লাসিক’, সামহোয়্যার ইন ব্লগ 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
দু-বোতল মহুয়া খেয়ে ‘অবনী বাড়ি আছো’ লিখলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়

More From Author See More