প্রপেলারের মাধ্যমেই ছুটত রেলগাড়ি! বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপের অভিনব প্রযুক্তি

১৮০২ সাল। বিশ্বের প্রথম বাষ্পচালিত লোকোমোটিভ ইঞ্জিন তৈরি করে তাক লাগিয়েছিলেন ব্রিটিশ গবেষক রিচার্ড ট্রেভিথিক। পরবর্তীতে বিদ্যুৎচালিত রেল ইঞ্জিন থেকে শুরু করে চৌম্বক ক্ষেত্র-চালিত বায়ুতে ভাসমান ম্যাগপ্লেন— সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রমশ আধুনিকতার পথে হেঁটেছে রেল-প্রযুক্তি। তবে যদি বলা হয়, একসময় প্রপেলারের মাধ্যমেও ছুটত রেলগাড়ি?

ভুরু কোঁচকাবেন অনেকেই। সাধারণত প্রপেলারের (Propeller) সাহায্যেই আকাশে ওড়ে হেলিকপ্টার, বিমান। জাহাজ, স্টিমার বা সাবমেরিনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে তার। কিন্তু প্রপেলারযুক্ত রেলগাড়ি (Railcar) মনে মনে কল্পনা করাটাও বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে উনিশ শতকে দ্রুতগতি সম্পন্ন রেলইঞ্জিন তৈরি করতে, এমন আশ্চর্য নকশা তৈরি করেছিলেন ইউরোপীয় প্রযুক্তিবিদরা। নজিরবিহীন সাফল্যও পেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু তা-ই যদি হয়, তবে কীভাবে হারিয়ে গেল এই উন্নত মানের ইঞ্জিন? কেনই-বা ইউরোপের গণ্ডির বাইরে পা-রাখা হল না তার?

আসলে উনিশ শতকের শেষের দিক থেকেই প্রথাগত কয়লা বা বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের বিকল্প খোঁজা শুরু হয়েছিল সুইজারল্যান্ড-সহ ইউরোপের একাধিক দেশে। মূলত এইসব দেশে কয়লার সংকটই প্রধান কারণ হয়ে উঠে বিকল্প-অনুসন্ধানের। সেই সূত্র ধরেই আবিষ্কৃত হয় ‘ফায়ারলেস লোকোমোটিভ’। এ-ধরনের ইঞ্জিনে কয়লার দহনের পরিবর্তে ডিজেল জ্বালানির মাধ্যমে চালিত বৈদ্যুতিক যন্ত্রের মাধ্যমে বাষ্পীভূত করা হত বয়লারে সংরক্ষিত জল। এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের কারণে ‘ইলেকট্রিক-স্টিম হাইব্রিড’ নামেও পরিচিত ছিল এই ইঞ্জিন।

পরবর্তীতে এই ইঞ্জিনের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই গবেষকরা তৈরি করেন প্রপেলার চালিত রেল-ইঞ্জিন। ততদিনে আবিষ্কৃত হয়ে গেছে বিমান। গোটা বিশ্ব দেখেছে, প্রপেলারের মাধ্যমে আস্ত একটি ধাতব যানকে আকাশে ওড়ানো সম্ভব। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হয় প্রপেলারচালিত যুদ্ধবিমানের। প্রপেলারচালিত রেলইঞ্জিন তৈরির চিন্তাভাবনাও শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই। নেপথ্যে, সোভিয়েত প্রকৌশলী ভ্যালেরিয়ান আবাকোভস্কি। 

সাধারণ রেল ওয়াগানের সামনেই তিনি যুক্ত করেছিলেন প্রকাণ্ড টুইন-ব্লেড প্রপেলার। বিমানের মতোই এই প্রপেলার ঘোরাতে সাহায্য করত ডিজেল বা পেট্রোল চালিত ইঞ্জিন। ‘এরোওয়াগান’-খ্যাত আবাকোভস্কির এই রেল ছুটতে পারত প্রায় ১৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিবেগে। ১৯১৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ায় চালু হয় এই বিশেষ রেলইঞ্জিনের ব্যবহার। অবশ্য দীর্ঘ রেলগাড়ি নয়, বরং একটি মাত্র কামরা নিয়েই তৈরি হত এই বিশেষধরনের ওয়াগান। বলাই বাহুল্য, এহেন দ্রুতগতি-সম্পন্ন রেলইঞ্জিন সে-যুগে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা ইউরোপে। তবে এই চালু হওয়ার মাত্র ৪ বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় আবাকোভস্কির এই ইঞ্জিনের ব্যবহার। ১৯২১ সালের ২৪ জুলাই, রাশিয়ার টিউলা থেকে মস্কো যাওয়ার পথে লাইনচ্যুত হয় এরোওয়াগন। ২২ জন যাত্রীর মধ্যে নিহত হয়েছিলেন ৭ জন। সেই তালিকায় ছিলেন প্রযুক্তির আবিষ্কারক স্বয়ং আবাকোভস্কিও। নিজের আবিষ্কারই প্রাণ কেড়ে নেয় তাঁর। 

অবশ্য রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়নে এই রেলের ব্যবহার বন্ধ হলেও, ইউরোপের একাধিক দেশ ইঁদুরদৌড়ে নেমেছিল এই প্রযুক্তিকে ত্রুটিহীন এবং নিরাপদ করে তোলার জন্য। গবেষণার এই লড়াইয়ে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল জার্মানি। টিউলা রেল-দুর্ঘটনার আট বছর পর, আবাকোভস্কির তৈরি প্রপেলারচালিত ওয়াগানের মডেলের ওপর ভিত্তি করেই বিশেষ রেলকার ডিজাইন করেন জার্মান প্রযুক্তিবিদ ফ্রানৎস ক্রুকেনবার্গ। এই নতুন যানের নাম রাখেন ‘স্কিনেনজেপেলিন’। যার অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘রেল জেপেলিন’। হ্যাঁ, আকারে-আকৃতিতে এই রেলকার জার্মান বিমানপোত বা জেপেলিনের মতো দেখতে হওয়ায়, এহেন নাম রাখা হয় এই যানটির। 

স্কিনেনজেপেলিন 

 

ফ্রানৎস বুঝতে পেরেছিলেন, গাড়ির সামনে প্রপেলার সংযোজনই দুর্ঘটনার দিকে ঠেলে দিয়েছিল সোভিয়েতের প্রপেলার-চালিত রেল ‘এরোওয়াগন’-কে। গাড়ির সামনের অংশে প্রপেলার থাকার কারণে, বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী চাপে লাইনচ্যুত হয় এই গাড়ি। ফলে নিজের নকশাকৃত রেলকারের পিছনের অংশে প্রপেলার সংযুক্ত করেন ফ্রানৎস। 

প্রাথমিকভাবে ২৫ মিটার দীর্ঘ এবং ২.৮ মিটার উঁচু এই রেলগাড়িকে চালানোর জন্য ব্যবহৃত হত বিএমডব্লুর ৬-সিলিন্ডারের পেট্রোল এয়ারক্রাফট ইঞ্জিন। পরবর্তীতে চার ব্লেডের প্রপেলারযুক্ত এই ইঞ্জিনকে প্রতিস্থাপিত করে ৬০০ হর্সপাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন বিএমডব্লুর ১২ সিলিন্ডারের পেট্রোল ইঞ্জিন। তবে লোহা নয়, বরং এই বিশেষ রেলকারের কর্মক্ষমতা বাড়ানো এবং সার্বিক ওজন কমানোর জন্য, তার বাইরের কাঠামো তৈরি করা হত অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে। 

৪০ জন যাত্রীবাহী এই যান সে-যুগে হয়ে উঠেছিল ইউরোপের সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন রেল। নিয়মিতভাবে ২০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে ছুটত এই স্কিনেনজেপেলিন। তাছাড়াও ১৯৩১ সালে জার্মানির হামবুর্গ শহর থেকে ডারজেনথিন যাওয়ার পথে ২৩০ কিলোমিটার সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে বিশ্বরেকর্ড তৈরি করেছিল এই রেল। মজার বিষয় হল, ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত অক্ষত ছিল স্কিনেনজেপেলিনের এই রেকর্ড। তৎকালীন সময় আধুনিক বিদ্যুৎচালিত রেলইঞ্জিনের প্রচলন হওয়ার পর হার মানে জার্মান প্রযুক্তিটি। তবে এখনও বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন পেট্রোল-চালিত রেলইঞ্জিন এটিই। 

যদিও এই ব্যাপক সাফলের পরও বাতিল হতে হয়েছিল স্কিনেনজেপেলিনকে। তার কারণ, দ্রুত গতিতে ছুটতে পারলেও, বড়ো রেলগাড়ি টানতে অক্ষম ছিল এই ইঞ্জিন। পাশাপাশি তার ধারণ ক্ষমতাও ছিল সীমিত। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরই বাতিল হয় এই বিলাসবহুল রেলকার। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই প্রযুক্তিকে প্রতিস্থাপিত করে বিদ্যুৎচালিত রেলইঞ্জিন। গতিতে স্কিনেনজেপেলিনের থেকে পিছিয়ে থাকলেও, সেই রেলগাড়ির কর্মক্ষমতা ছিল বহুগুণ। ফলে, গুরুত্ব হারায় প্রপেলার-চালিত রেলইঞ্জিন। ক্রমশ তলিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে। 

Powered by Froala Editor