জোসেফ বেল : শার্লক সৃষ্টির নেপথ্যে ছিলেন আর্থার কোনান ডয়ালের এই বিচক্ষণ শিক্ষক

স্বভাবে বোহেমিয়ান, চরিত্রে ভাবুক। দোহারা লম্বা চেহারা। মাথায় ফেল্ট হ্যাট। মুখে সর্বক্ষণ পাইপ। কোকেনের প্রতি তীব্র আসক্তি। আবার ভায়োলিনবাদন বা রসায়ন বিজ্ঞানেও তুখোড় পারদর্শিতা। কল্পনাপ্রবণ অথচ তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার অধিকারী এই মানুষটির ঠিকানা ২২১/বি বেকার স্ট্রিট। সাহিত্যপ্রেমী কোনো মানুষকেই আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না এই চরিত্রটির সঙ্গে। শার্লক হোমস। ১৮৮৭ সালে ‘বিটন’স ক্রিসমাস অ্যানুয়াল’-এ প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল স্যার আর্থার কোনান ডয়ালের এই গোয়েন্দা চরিত্রটি। প্রথমে জনপ্রিয়তা না-পেলেও, অল্পদিনের মধ্যেই বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে জায়গা করে নেয় শার্লক (Sherlock Holmes)। কিন্তু এই চরিত্র কি পুরোটাই কাল্পনিক? নাকি বাস্তব জীবনে সত্যিই এমন কোনো ব্যক্তির দেখা পেয়েছিলেন স্যার আর্থার কোনান ডয়াল (Sir Arthur Conan Doyle)?

এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে, অন্য একটা কাহিনি দিয়ে শুরু করা যাক গল্পটা। ১৮৯৩ সাল। অকুস্থল স্কটল্যান্ডের আর্জিল প্রদেশের আর্ডলামন্ট এস্টেট। দিন কয়েকের জন্য লিজে গোটা সম্পত্তিটির মালিকানা আদায় করেছিলেন আলফ্রেড জন মনসন নামের এক ব্যক্তি। পেশায় তিনি গৃহশিক্ষক। নর্থহামটনশায়ারের সম্ভ্রান্ত হ্যামব্রোও পরিবারের ‘জেন্টলম্যানস টিউটর’। তবে মনসন একা নন, আর্ডলামন্ট এস্টেটে তাঁর সঙ্গেই শিকারের প্রশিক্ষণ নিতে এসেছিলেন তাঁর ছাত্র তথা হ্যামব্রোও পরিবারের সদস্য, বছর কুড়ির সিসিল। সঙ্গী হয়েছিলেন আরও এক রহস্যময় তৃতীয় ব্যক্তি, এডওয়ার্ড স্কট। তিনি মনসনের বন্ধু। পেশায় প্রযুক্তিবিদ। 

ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ছিল ১৮৯৩ সালের ১০ আগস্ট। বন্ধু এডওয়ার্ড এবং ছাত্র সিসিলকে নিয়ে শিকারে বেরিয়েছিলেন মনসন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই জঙ্গল থেকে বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পান এস্টেটের কর্মীরা। তাতে তাঁরা যে আশ্চর্য হয়েছিলেন, এমনটা নয়। শিকারে গিয়ে রোজই কম-বেশি বন্দুক চালান স্থানীয়রা। তবে কয়েক মুহূর্ত পরই তাঁদের নজর কাড়ে আশ্চর্য এক দৃশ্য। ছুটতে ছুটতে কটেজে ফিরছেন মনসন এবং স্কট। হাতে ধরা বন্দুকের নল পরিষ্কার করছেন কাপড় দিয়ে। ব্যাপার কী? হ্যামব্রোওই-বা কোথায়? উত্তর পাওয়া গিয়েছিল কয়েক মিনিট পরে। মনসন জানিয়েছিলেন, দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে তাঁর। বেড়া টপকাতে গিয়ে ভুলবশত বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিয়ে ফেলেন সিসিল। আর তাতেই তার মাথায় গুলি লেগে মৃত্যু হয় তাঁর। আশ্চর্যের বিষয় হল, এর ঠিক ছ’দিন আগেই দুটি জীবন বীমা করিয়েছিলেন সিসিল। আর সেগুলির জন্য উত্তরসূরি হিসাবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন মনসনের স্ত্রীকে।

সবমিলিয়ে আপাত-দুর্ঘটনা ঘিরে তৈরি হয় এক জটিল ধাঁধাঁ। সম্ভ্রান্ত স্কটিশ পরিবারের সদস্য হওয়ায় সিসিলের এই মৃত্যুর ঘটনা পৌঁছেছিল আদালতেও। বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হয়েছিল এই ‘হত্যাকাণ্ড’। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ কমিটি। সেই কমিটিরই অন্যতম এক সদস্য ছিলেন এডিনবার্গের স্কটিশ সার্জেন এবং ফরেনসিক বিশ্লেষক জোসেফ বেল (Joseph Bell)। সে-সময় তিনি সিসিল হ্যামব্রোও-র মৃতদেহ বিশ্লেষণ করে দাবি করেছিলেন, নিজে থেকে বন্দুক চালাননি হ্যামব্রোও। দাবি করেন, হ্যামব্রোও-কে হত্যা করেছেন মনসনই। তাঁর এই দাবি সে-সময় গোটা ব্রিটেনে সাড়া ফেলে দিলেও, শেষ পর্যন্ত শেষ উপযুক্ত প্রমাণাভাবে মনসনকে মুক্ত করে ব্রিটিশ আদালত। কে এই জোসেফ বেল? কেনই-বা তাঁর সামান্য দাবিকে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন সময়ে? 

বাস্তবে শার্লক হোমস নামের কোনো প্রাইভেট ডিটেক্টিভ থাকুক আর না-থাকুক, এই কাল্পনিক চরিত্রটি গড়ে ওঠার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন জোসেফ বেল। কীভাবে? 

উত্তর পেতে পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক বছর। ১৮৩৭ সালে জোসেফের জন্ম এডিনবড়া অর্থাৎ এডিবার্গে। ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবার্গ মেডিক্যাল স্কুল থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিলাভের পর জোসেফ কাজ শুরু করেন ‘রয়্যাল কলেজ অফ সার্জেনস’ এবং ‘এডিনবার্গ রয়্যাল ইনফার্মারি’-তে। অল্পদিনের মধ্যেই স্কটল্যান্ড অন্যতম খ্যাতনামা চিকিৎসক এবং ফরেনসিক গবেষক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। 

১৮৭৭ সালে এডিনবার্গ রয়্যাল ইনফার্মারিতেই প্রথমবারের জন্য জোসেফের সাক্ষাৎ পান শার্লক-স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়াল। তাঁরই ছাত্র ছিলেন আর্থার। পরবর্তীতে তাঁকে নিজের ক্লার্ক হিসাবে নিযুক্ত করেন জোসেফ। সে-সময়ই খুব কাজ থেকে তাঁকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন কিংবদন্তি ব্রিটি-সাহিত্যিক। বা, বলা ভালো মুগ্ধ হয়েছিলেন তাঁর কাজের পদ্ধতি এবং জ্ঞান দেখে। শুধু চিকিৎসা বা রোগনির্ণয়ই নয়, জোসেফের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা রীতিমতো অবাক করে দিয়েছিল কোনান ডয়ালকে। দূর থেকে দেখেই তিনি বলে দিতে পারতেন কোন রোগী পেশায় রাজমিস্ত্রি, কে গির্জায় থাকেন, কে সৈনিক বা নাবিক। কখনও আবার বাহ্যিক আচরণ দেখেই বুঝে যেতেন তাঁদের সমস্যার কথা। কোনান ডয়েল তো বটেই, তাঁর এই অদ্ভুত অনুমান-ক্ষমতা হতবাক করে দিত তাঁর কাছে আসা রোগীদেরও। 

জোসেফের পর্যবেক্ষণ এবং বুদ্ধিমত্তার সম্পর্কে অনুমান পাওয়া যায় আর্থার কোনান ডয়ালের আত্মজীবনী ‘মেমোরিস অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার’ থেকে। সেখানে জোসেফের সম্পর্কে আর্থার লিখেছেন, নাম নথিভুক্ত করার সময় রোগীদের জিজ্ঞাসা করে তিনি যে-টুকু তথ্য জানতে পারতেন তাঁদের সম্পর্কে, তার থেকেও কয়েকগুণ বেশি তথ্য মজুত থাকত জোসেফের ভাঁড়ারে। শুধুমাত্র অনুমান এবং পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করেই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতেন তিনি। আর্থার এও লেখেন, জোসেফের দেখাদেখি মনে মনে ‘প্রিসাম্পশন অ্যান্ড ডিডাকশন’-এর পথে হাঁটতে শুরু করেন তিনিও। সবসময় সাফল্য না-পেলেও, জোসেফের শেখানো বিদ্যায় মাঝে মাঝে দিব্যি কাজ হত। 

এই স্কটিশ সার্জেন এবং অধ্যাপক যে বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল আর্থারকে, সে-কথা এতটুকু লুকাননি তিনি। বরং, জানিয়েছিলেন কাছ থেকে দীর্ঘদিন জোসেফকে পর্যবেক্ষণ এবং অধ্যয়ন করার পরেই শার্লককে গড়েছেন তিনি। সেই কারণেই হয়তো শার্লক গোয়েন্দাগিরির পাশাপাশি দক্ষ বিজ্ঞান অনুশীলনেও। আর শার্লকের সর্বক্ষণের সহকারী সঙ্গী, তার নিকটতম বন্ধু ওয়াটসন? এই চরিত্রটির জায়গায় কি নিজেকেই বসিয়েছিলেন কোনান ডয়াল? যে-ভাবে জোসেফ তাঁকে বুঝিয়ে দিতেন অনুমান পদ্ধতি, সেভাবেই তো প্রতি গল্পে শার্লক নিজের বিচক্ষণতার, ডিডাকশন মেথডের ব্যাখ্যা দিয়েছে বন্ধু ওয়াটসনকে। সেই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া চলে না মোটেই। 

১৮৮৭ সালে ‘আ স্টাডি ইন স্কার্লেট’ গল্পে সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করে শার্লক হোমস। তবে শার্লক ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ১৮৯০ সালের পর। বিখ্যাত স্ট্র্যান্ড পত্রিকায় সে-সময় ছাপা হতে শুরু করে শার্লকের গল্প। প্রকাশ্যে আসে জোসেফের কাহিনিও। একদিকে যেমন শার্লকের সৌজন্যে পাঠকমহলে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন আর্থার, তেমনই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর শিক্ষক, থুড়ি শার্লক-সৃষ্টির অনুপ্রেরণা জোসেফেরও। ১৮৮০-এর দশকের এডিনবার্গ পুলিশের তদন্তে তিনি একাধিকবার ফরেনসিক রিপোর্ট প্রস্তুত করলেও, ১৮৯০-এর দশকে সরাসরি তাঁর কাছে দ্বারস্থ হয় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। বিভিন্ন সময় তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে যেতেন দুঁদে স্কটিশ পুলিশ অফিসাররা। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে জোসেফ তাঁদের হাতে তুলে দিতেন সন্দেহভাজন ব্যক্তির সম্পর্কে নানা তথ্য।

অবশ্য পুলিশকে সাহায্য করলেও, প্রকাশ্যে জোসেফ কোনোদিনই স্বীকার করেননি যে শার্লকের অনুপ্রেরণা তিনি। জানিয়েছিলেন, শার্লক চরিত্রটি সম্পূর্ণভাবেই তাঁর শ্রেষ্ঠ ছাত্র আর্থারের সৃষ্টি। তাছাড়া তিনি মোটেই শার্লকের মতো অপরিচ্ছন্ন নন, আসক্তি নেই কোকেনে, এমনকি বেহালাও বাজাতে পারেন না। যদিও তাঁর এই দাবিকে সে-যুগে আমল দেননি কেউ-ই। ব্রিটেনের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁকে নিয়ে গল্প বেরিয়েছে নিরন্তর। রটেছে বহু গুজবও। জন্ম নিয়েছে নানান কিংবদন্তি। শার্লকের মতোই আজও প্রচণ্ডভাবেই টিকে রয়েছে সেইসব রহস্যমোড়া গল্পকাহিনি। ২২১/নি বেকার স্ট্রিটে কান পাতলে আজও শোনা যায় সেসব কিংবদন্তি… 

Powered by Froala Editor