বাড়ির গরুর দুধ দিয়েই তৈরি চা, আহিরীটোলা ঘাটে আড্ডাপ্রেমীদের নিশ্চিত ঠিকানা সাধুবাবার দোকান

দিনের সূর্য শেষ আলোটুকু ছড়িয়ে দিয়ে ডুবে গেল হুগলি নদীর বুকে। সারাদিনের ব্যস্ততার মধ্যেও এই একটু সময় খুঁজে নিয়ে গঙ্গার ঘাটে ঘাটে ভিড় করেছেন কলকাতাবাসী। আর ঠিক সেইসময়েই ঘাটের পাশে চায়ের দোকানে দোকানে জ্বলে উঠছে উনুনের আগুন। আহিরীটোলা ঘাটের কাছেও চায়ের দোকানের সংখ্যাটা নেহাৎ কম নয়। তবে তার মধ্যেই আলাদা করে চোখে পড়বে একটি দোকান। লাল চেলির পোশাক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা; যে মানুষটি উনুনে আগুন ধরাচ্ছেন তিনিও আর পাঁচজন দোকানির মতো নন। আহিরীটোলা ঘাটের কাছে, ভূতনাথ মন্দিরের সামনে গিয়ে সাধুবাবার দোকান বললেই একডাকে সবাই দেখিয়ে দেবেন দোকানটি।

“দোকানটা তৈরি করেছিলেন বাবা। আমি তখনও জন্মাইনি। দোকানের বয়স কত, ঠিক জানি না। তবে আমার বয়স ৫০ পেরিয়ে গিয়েছে।” ভাঙা ভাঙা বাংলার সঙ্গে কিছুটা হিন্দি মিশিয়ে বলছিলেন হরিশঙ্কর পাণ্ডে। ততক্ষণে অবশ্য দোকানের সামনে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে ক্রেতাদের আনাগোনা শুরু হয়ে গিয়েছে। ঘন হয়ে ফুটতে থাকা দুধে চা পাতা দিতে দিতে হরিশঙ্কর ওরফে সাধুবাবা বলছিলেন, “এই দুধ কিন্তু বাজার থেকে কেনা নয়। আমার বাড়ির গরুর দুধ দিয়ে চা বানাই। এখানে কোনো ভেজাল পাবেন না।” ক্রেতার সংখ্যা দেখলেই তাঁর জনপ্রিয়তাও বোঝা যায়। আশেপাশে চায়ের দোকানের সংখ্যা কম নয়। সেখানে দামও তুলনায় অনেকটা কম। তাহলে কেন আসেন এত ক্রেতা? প্রত্যেকের উত্তর একই। “চায়ের এমন স্বাদ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।”

হরিশঙ্কর পাণ্ডে বলে চলেছিলেন দোকানের জন্ম ইতিহাস। “বাবার নাম ছিল শিবদাস। আমাদের দেশ পাটনার কাছে। বাবা সেখান থেকেই এসেছিলেন কলকাতা।” ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় বিহার, ওড়িশাথেকে এমন অনেকেই তখন এসেছিলেন শহর কলকাতায়। স্বাধীন দেশে তখন রাজ্য পুণর্গঠন চলছে। অথচ পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড়ো বাণিজ্যিক এলাকা কলকাতা। পাছে নতুন রাজ্যের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়, এই আশঙ্কায় অনেকেই চলে এসেছিলেন শহরে। “অনেক জায়গায় কাজের জন্য ঘুরেছিলেন তিনি। আর এই ভূতনাথ মন্দিরেই থাকতে শুরু করেছিলেন। তখনই একদিন ঠিক করলেন, সন্ধ্যার সময় ঘাটে যাঁরা বেড়াতে আসেন তাঁদের হাতে এক কাপ করে দুধ তুলে দেবেন। তবে বাঙালিরা তো দুধ খেতে তেমন ভালোবাসেন না। তাই সেখান থেকেই শুরু হল চা বিক্রি।”

এই চায়ের দোকানকে ঘিরেই বেড়ে উঠেছেন হরিশঙ্কর পাণ্ডে। আর জীবনকে ঘিরে রেখেছে ভূতনাথ মন্দির। শিবদাসের সময় থেকেই তাঁরা মন্দিরের পারিবারিক সেবায়িত। আর সেখান থেকেই পেয়ে গেলেন ডাকনাম ‘সাধুবাবা’। কলকাতার ঘাটের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে সাধুবাবার চায়ের দোকান। ব্যবসার পরিসর এখন আরও বেড়েছে। হরিশঙ্কর একা সামলাতে পারেন না। সর্বক্ষণের সঙ্গী হিসাবে এগিয়ে এসেছেন অমন সাউ নামে এক প্রতিবেশী। তিনিও ছেলেবেলাতেই চলে এসেছেন বিহার ছেড়ে। কলকাতার বুকেই অন্য কলকাতার এমন নানা ছবি দেখা যায় সন্ধ্যার গঙ্গার ঘাটে ঘাটে।

আরও পড়ুন
প্রতি সন্ধ্যায় গড়ের মাঠে আড্ডা জমাতেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, ‘ময়দান ক্লাবের আড্ডা’ নাম দিলেন গান্ধীজি

Powered by Froala Editor

More From Author See More