বাঙালির চায়ের নেশায় বিরক্ত আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, তুলনা করেছিলেন হুইস্কির সঙ্গেও

“আমরা কি চা খাব না? খাব না চা আমরা?”

প্রশ্নটা নিয়ে হালফিলে অনেক কিছুই ঘুরে বেড়াচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যে ভদ্রলোক এই প্রশ্নটা ছুঁড়েছেন সমাজের উদ্দেশে, তাঁকে লক্ষ্য করে শোনা গিয়েছে সাংবাদিকের তীব্র প্রতিবাদ। আশ্চর্য ব্যাপার, আজ থেকে ৮৫ বছর আগে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ও বলছেন এক কথা - “না, খাবেন না চা!”

“কলিকাতা, বোম্বাই প্রভৃতি নগরের স্বল্প বেতনভুক, শীর্ণ কেরাণী আহার্য্য ও পানীয়ের উভয়বিধ প্রয়োজন চা পানের দ্বারাই মিটাইয়া থাকেন। উহাতে ক্ষুধা নষ্ট হয়, সুতরাং ব্যয়সাধ্য পুষ্টিকর আহার্য্যেও আর প্রয়োজন পড়ে না। …হুইস্কির বোতল কিংবা চায়ের পাত্র ইহাদের কোনটি যে অধিকতর মারাত্মক, তাহা নিশ্চিতরূপে বলা কঠিন”, 'চা-এর প্রচার ও দেশের সর্ব্বনাশ'-এ সাফ বক্তব্য আচার্যের।

খেয়াল না করলেই নয়, অধুনা সময়ের সাংবাদিক এবং বিখ্যাত এই বাঙালির চা-পান নিয়ে এই যে নিষেধাজ্ঞা- দুইয়েরই শিকড় রয়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক সঙ্কটে। চা-পানে স্বাস্থ্য নষ্ট হবে আর বর্তমান সময়ে পথে বেরোলে রোগ সংক্রমণ হবে - এই যা যুক্তিতে তফাত!

কিন্তু ভারতবাসীর চায়ের নেশা যে শুরু হয়েছে রাস্তা থেকে, এটাই বা কী করে ভুলে যাওয়া যায়! ১৮৫৪ সালে সিলেটের বাগানে চাষ হল পাতার, তার পর থেকে চায়ের নেশাকে চাড়িয়ে দেওয়ার জন্যই রাস্তাই তো ঔপনিবেশিক শাসকের অবলম্বন। যেখানেই ভিড়, সেখানেই তখন চায়ের ছোট ছোট দোকান, নজরকাড়া হরেক বিজ্ঞাপন। রেলের স্টেশন, লঞ্চঘাট, কারখানাকে ঘিরে অহরহ প্রচার। বিজ্ঞাপনের মূল বক্তব্য একেবারে উইলিয়াম ইওয়ার্ট গ্ল্যাডস্টোনের কবিতার মানানসই-

“চা রাখবে উষ্ণ যদি শীতে জ্বরজ্বর,
স্নিগ্ধ করবে শরীর যদি গ্রীষ্মে কাতর,
স্ফূর্তি আনবে মনে যদি জাগে অবসাদ,
শান্ত করে রুখবে উত্তেজনার পরমাদ।"

কিন্তু ভবি ভোলার নয়! কোথাও একটা গিয়ে ঠিক যেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সমান্তরালেই চলে আসে চা-পানের বিরোধিতা নিয়ে বাঙালিদের প্রতিবাদ। এ যুগের হাওয়ায় শাণিত ব্যঙ্গের হাতিয়ার সোশ্যাল মিডিয়ার মিম, অতীতে বাঙালিরা কবিতাতেই জুতসই জবাব তুলে ধরছেন বিদেশি কবির বিপক্ষে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় যখন দেশ পত্রিকার তৃতীয় বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় ১৯৩৫ সালে চা-পানের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন, তার আরও পাঁচ বছর আগে কলম ধরেছেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। তাঁর কবিতা বলছে, শুধু 'স্বল্প বেতনভুক, শীর্ণ কেরাণী'-ই নয়, অর্থানুকূল্য আছে এমন ব্যক্তিরও বিপদ হতে পারে চা-পানের অভ্যাসে। উদাহরণ হিসেবে মল্লিক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন এক রামসুক পালোয়ানকে।

পালোয়ান রামসুক তেওয়ারি বাংলায় এসেছিলেন ভাগ্য বদলাতে। ভাগ্য যা ছিল, তা বদলাল ঠিকই, তবে মন্দের খাতে! কেন না, বাংলায় দিন কয়েক কাটিয়েই রামসুক হয়ে উঠেছেন পাক্কা চা-খোর। এখন নেশার ঘোরে পড়লে যা হয়, পালোয়ানের সঙ্গেও তা-ই হল। শরীর চর্চা থেকে সরে গেল খরচার খাতে। দিনে রাতে ঘন ঘন চায়ে চুমুকে প্রথমে দেখা দিল হজমের সমস্যা, তার পরে দ্রুত পড়ে গেল স্বাস্থ্য। শেষটা শুরু হয়ে গেল যমে আর রামসুকে পালোয়ানি, সবাই চিন্তায়, কে জেতে আর কে-ই বা হারে!

“অবশেষে অসুখের সংবাদ পাইয়া,
দেশ থেকে ধেয়ে এলো দেশওয়ালী ভাইয়া
করে দিল প্রথমেই চা খাওয়া-টা বন্ধ
বে-ভাষায় বললো সে কত কী যে মন্দ"

পরিস্থিতি কেমন চেনা চেনা ঠেকছে না? হরেক ভাষায় যে ভদ্রলোক গামছা গায়ে বেরিয়েছিলেন চা খেতে, তাঁকে নিয়েও তো ' কত কী যে মন্দ' বলে চলেছে সোশ্যাল মিডিয়া। বুঝতেই পারছেন না অনেকে - জমায়েত না করার নিষেধাজ্ঞা মানতে ভদ্রলোকের আপত্তি নেই। তাঁর বিস্ময়টা অন্যত্র - তাঁর মতো অধিকাংশ শ্রমজীবীরই বাড়িতে চায়ের সংস্থান নেই, এ বার যদি পথে না বেরোন চা পাবেন কোথায়? আমরাও কি মুদির দোকানে যাচ্ছি না? যদিও ব্যঙ্গের মুখে পড়ে রামসুক আর ওই ভদ্রলোক, দুই ক্ষেত্রেই পরিণতি এক - 'চা খাওয়া-টা বন্ধ'! তেওয়ারী অবশ্য সেরে উঠেছিলেন চা-কে দরজা দেখিয়ে। আর এখানে নাম না-জানা ওই ভদ্রলোকের দরজা বন্ধ করে চা-ছাড়া জীবন কেমন কাটছে কে জানে!

আসলে উনিশ শতক থেকে এই দিন কয়েক আগে পর্যন্ত বাঙালির চা খাওয়ায় এমন বাধা আসেনি। বিলাসিতার গণ্ডি পেরিয়ে চা অনেক দিন হয়ে গেল প্রয়েজনের খাতায়। ব্রিটিশ বিদায় নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আরও অনেক কিছুর সঙ্গে ছেড়ে গিয়েছে এই চা পানের হ্যাংওভার। যে চাপান-উতোরের ছবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এঁকে গিয়েছেন 'সেই সময়' উপন্যাসে।

স্থান ইয়ং বেঙ্গল-এর এক গোলটেবিল বৈঠক, রামগোপাল ঘোষের বাড়িতে। "ভৃত্যেরা টেবিলের উপরে সাজিয়ে দিয়ে গেছে গেলাস ও বিভিন্ন প্রকার সুরার বোতল… শুধু রামগোপালের সামনে একটি বিচিত্র আকৃতির পোর্সিলিনের পাত্র। রামগোপাল মৃদু হেসে বললেন, … ইদানীং এইটি পান করা আমার অভ্যাস হয়ে গেচে।" অতঃপর তিনি এই নতুন পানীয়ে দীক্ষা দিলেন কৌতূহলী বান্ধব প্যারীচাঁদ মিত্রকে- “লাইক কিসিং এ ড্যামজেল… অ্যান্ড ইউ ওয়ান্ট টু কিস এগেইন"। প্রথমে 'একটু তিক্ত, একটু কষায়' লাগলেও মুহূর্ত পরেই চায়ের স্বাদে মজলেন প্যারীচাঁদ।

“রামগোপাল জিজ্ঞেস করলেন, কেমন, শরীরে বেশ একটা চনমনে ভাব হয়নি?

প্যারীচাঁদ বললেন, বিলক্ষণ!

রামগোপাল আবার জিজ্ঞেস করলেন, মনে হয় না আবার চুম্বন করি, আবার, আবার?”

লকডাউনের সময়ে অনেক শ্রমজীবী বাঙালি আদতে এই চুম্বনরসে বঞ্চিত। ২০১৭ সালেই পত্রিকা জগতের 'গার্ডিয়ান' ঘোষণা দিয়েছে - সারা ভারতে রাস্তায় তৈরি চায়ের নিরিখে কলকাতা-ই সেরা। অতএব সেই শহরের মানুষ যদি পথে নেমে চা-পানে বাধা পায়, বিস্মিত হবে না?

তথ্যসূত্র: সেই সময়/সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
গার্ডিয়ান
সার্চলাইট বাংলাদেশ