কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের আস্ত ব্যাটেলিয়ান, ‘লড়েছিল’ বিশ্বযুদ্ধের ময়দানেও

৩১ জানুয়ারি, ১৮৬৫। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই তারিখটা এক ঐতিহাসিক দিন। এই দিনেই যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে পাস হওয়া বিশেষ বিলের মাধ্যমে অবলুপ্ত হয়েছিল দাসত্ব। অবশ্য দাসত্ব থেকে মুক্তি পেলেও, সমাজের মূল স্রোতে ফিরতে কৃষ্ণাঙ্গদের লড়াই করতে হয়েছিল আরও কয়েক দশক। এমনকি এই বৈষম্য মুছে ফেলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুকে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গড়ে উঠেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। যার ফলস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের বুকে তৈরি হয় ‘অল উইমেন, অল ব্ল্যাক ব্যাটেলিয়ন’। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (World War II) ময়দানে একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের ব্যাটেলিয়ন (All Women All Black Battalion) হিসাবে ‘লড়াই’ করেছিলেন তাঁরাই।

এই গল্পের শুরু ১৯২৭ সালে। এলিনর রুজভেল্টের ‘ফার্স্ট লেডি’ হয়ে উঠতে তখনও বেশ কয়েক বছর বাকি। সে-সময় প্রতিবেশী, শিক্ষাবিদ এবং অধিকারীকর্মী মেরি ম্যাকলিওড-এর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল এলিনরের। ১৯৩৩ সালে রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর, সেই সূত্রেই তিনি মেরি ম্যাকলিওডকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত করেন ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট। 

সে-সময় কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে শিক্ষা— যক্তরাষ্ট্রে একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে চলেছেন কৃষাঙ্গরা। যথাসম্ভব এইসব সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন ম্যাকলিওড। তাছাড়াও ১৯৩৯ সালে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য ম্যাকলিওডের নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছিল ব্ল্যাক ক্যাবিনেট। 

মজার বিষয় হল, এই ক্যাবিনেট যখন তৈরি হয়, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলেও তার অংশ হয়ে ওঠেনি যুক্তরাষ্ট্র। ফলে তখনও পর্যন্ত ব্যাপক মাত্রায় সেনাবাহিনী নিয়োগের কাজ শুরু হয়নি সেখানে। ১৯৪১ সালে জাপান পার্ল হার্বার আক্রমণ করলে, টনক নড়ে মার্কিনিদের। শুরু হয় ইউরোপে লড়াইয়ের প্রস্তুতি। গলিতে গলিতে পোস্টার পড়ে সেনা নিয়োগের। রেডিওতেও ঘোষণা করা হয় বিজ্ঞপ্তি। অথচ, এই সংকট মুহূর্তেও মার্কিন সেনাবাহিনীতে সুযোগ দেওয়া হত না কৃষ্ণাঙ্গদের। 

হ্যাঁ, এমনটাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর নিয়ম। এই রীতিতেই বদল আনে ম্যাকলিওডের ব্ল্যাক কমিটি। ফার্স্ট লেডি এলিনরের সাহায্যেই ম্যাকলিওডের হাত ধরে ১৯৪২ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর মহিলা ব্যাটেলিয়ন ‘উইমেন্স আর্মি কর্পস’ বা ‘ডব্লুএসি’-তে কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের অন্তর্ভুক্তি শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রে। যদিও কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের সাগ্রহে গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। সেখানেও বৈষম্যের শিকার হতে হত তাঁদের। সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নামা থেকে বিরত রাখা হয়েছিল তাঁদের। বদলে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল সুইচবোর্ড অপারেশন, বেকিং, মেকানিক্স, স্টেনোগ্রাফি, পোস্টাল ওয়ার্ক-সহ বিভিন্ন কাজে। এমনকি কোথাও কোথাও সেনাদের বাসন মাজা কিংবা ইউনিফর্ম কাচার কাজও করতে হত তাঁদের, এমন কথারও উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন নথিতে, বয়ানে। 

বিষয়গুলি প্রকাশ্যে আসার পর তা নিয়েও সরব হন ম্যাকলিওড। এমনকি ‘ডব্লুএসি’-র কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের কেন দেশের মধ্যেই ‘বন্দি’ রেখে বেসামরিক কাজ করানো হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। যার ফলস্বরূপ ১৯৪৪ সালের শেষলগ্নে, ব্রিটেনে পাঠানো হয় ডব্লুএসি-র প্রথম ‘অল ব্ল্যাক, অল উইমেন ব্যাটালিয়ন’। যা মার্কিন সেনাবাহিনীতে পরিচিত ছিল ৬৮৮৮তম সেন্ট্রাল পোস্টাল ডিরেক্টরি ব্যাটালিয়ন নামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ময়দানে লড়া শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের নিয়ে গঠিত একমাত্র বাহিনী ছিল এটিই। সে-সময় ৪০ লক্ষেরও বেশি মার্কিন সেনা অবস্থান করছে ইউরোপের বিভিন্ন অংশে। প্রতিদিনই লক্ষ লক্ষ চিঠি আসছে তাঁদের নামে। তাঁরাও প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন সেইসব চিঠির। ডাক বাছাই এবং সরবরাহের এই পাহাড়-প্রমাণ কাজের দায়িত্ব পেয়েছিল ‘ব্যাটেলিয়ন সিক্স ট্রিপল এইট’। 

পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বযুদ্ধের শেষ ৫ মাসে সবমিলিয়ে ৭ কোটি চিঠি গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করেছিল কৃষাঙ্গ মহিলাদের এই ব্যাটেলিয়ন। কাজেই আলাদা করে বলার অপেক্ষা থাকে না, বিশ্বযুদ্ধের ময়দানে বিশেষভাবে নিজেদের জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলারা। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের রিপোর্টও উল্লেখ করেছিল, ১৯৪৫ সালের শুরু থেকে বিদেশের মাটিতে ডাক পরিষেবার মান উন্নত হওয়ায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল সেনাদের মনে। 

যদিও এতকিছুর পরও যোগ্য সম্মাননা পাননি এই ব্যাটেলিয়নের মহিলারা। ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তনের পর ভেঙে দেওয়া হয় ৬৮৮৮তম পোস্টাল ডিরেক্টরি ব্যাটেলিয়ন। এমনকি এই ব্যাটেলিয়নের নেতৃত্বে থাকা মেজর অ্যাডামসকে লেফটেন্যান্টের পদে উন্নীত করা হলেও, আয়োজিত হয়নি কোনো স্বীকৃতি অনুষ্ঠান। দেওয়া হয়নি বাড়তি সম্মাননা। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসেও সবচেয়ে স্বল্পচর্চিত অধ্যায় হিসাবেই রয়ে গেছেন বিশ্বযুদ্ধের ময়দানে লড়া কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের একমাত্র এই ব্যাটেলিয়নের কাহিনি। মার্কিনিদের এই মনোভাব কিংবা বর্ণবৈষম্য, গোঁড়ামির প্রতীক নয়? বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আট দশক পরেও থেকে যায় এই প্রশ্ন…

Powered by Froala Editor

More From Author See More