তলিয়ে যাচ্ছে জাকার্তা, তড়িঘড়ি রাজধানী সরানোর পথে ইন্দোনেশিয়া

জনসংখ্যার নিরিখে চিন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের পরেই চতুর্থ স্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রে সবমিলিয়ে বাস ২৭ কোটি ৭২ লক্ষ মানুষের। তবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং উন্নয়নের চাপেই এবার ক্রমশ মাটির মধ্যে বসে যাচ্ছে বিশ্বের চতুর্থ জনবহুল দেশটির রাজধানী জাকার্তা (Jakarta)। ক্রমশ সমুদ্র গ্রাস করে নিচ্ছে এই শহরকে। অনুমান, দু’দশকের মধ্যেই তলিয়ে যেতে পারে শহরের এক-তৃতীয়াংশ। আর সেই কারণেই অন্যত্র তড়িঘড়ি রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যেতে চলেছে ইন্দোনেশিয়া (Indonesia)।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কেন মাটির তলায় বসে যাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নত শহরগুলির মধ্যে অন্যতম এই নগরী? ফিরে যেতে হবে কয়েক দশক। বিশ্বযুদ্ধের আগে ইন্দোনেশিয়া ছিল ওলোন্দাজ উপনিবেশ। বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান সম্পূর্ণভাবে অধিগ্রহণ করে নেন ইন্দোনেশিয়াকে। ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে জাপান আত্মসমর্পণ করার পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ইন্দোনেশিয়া। সে-সময় আজকের মতো উন্নত ছিল না ইন্দোনেশিয়া। ফলে দেশের প্রায় সমস্ত রাজস্ব খরচ করেই ঢেলে সাজানো হয়েছিল জার্কাতাকে। গড়ে তোলা হয়েছিল বাণিজ্য ও শিল্পের অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে। তবে উন্নয়নে এই শহরের থেকে পিছিয়ে ছিল ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল। 

কর্মক্ষেত্র এবং উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ থাকার কারণে তাই জার্কাতাতে ক্রমশ বাড়তে থাকে জনবসতি। ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল ছেড়ে মানুষ বসতি তৈরি করে জাকার্তায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৪৫ সালে জাকার্তার জনসংখ্যা ছিল ১০ লক্ষেরও কম। আজ যেখানে শুধুমাত্র এই শহরেই বসবাস ৩ কোটিরও বেশি মানুষের। অর্থাৎ, মাত্র ৮ দশকে প্রায় ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এই শহরের জনসংখ্যা। 

ক্রমবর্ধমান এই জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে ক্রমশ উত্তোলিত হয়েছে ভূগর্ভস্থ জল। আর সেখানেই তৈরি হয়েছে বড়ো মাত্রায় শূন্যস্থান। পাশাপাশি শহরজুড়ে গড়ে উঠেছে একের পর এক বহুতল। তাদের ভারেই ক্রমশ বসে যাচ্ছে গোটা শহরের মাটি। জাকার্তাকে গ্রাস করছে সমুদ্র। ২০৫০ সালের মধ্যে এই শহরের এক-তৃতীয়াংশই হারিয়ে যাবে সমুদ্রের তলায়, তেমনই আশঙ্কা গবেষকদের। তৈরি হতে পারে বড়ো আকারের সিঙ্কহোলও। সেদিক থেকে বিশ্বের দ্রুততম ডুবন্ত শহর হিসাবে নাম স্বীকৃতি পেয়েছে জাকার্তা। ইতিমধ্যেই সমুদ্র তীরবর্তী বেশ কিছু অংশ খালি করার নির্দেশ দিয়েছে জাকার্তা প্রশাসন। 

ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে রাজধানী অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজও। জাকার্তা থেকে ৮০০ মাইল দূরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপ বোর্নিও-তে নতুন রাজধানী তৈরির কাজ চলছে পুরোদমে। অনুমান, ২০২৪ সালের ১৭ আগস্ট, স্বাধীনতা দিবসের দিনই নতুন রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি পাবে বোর্নিও। অবশ্য এখনও পর্যন্ত এই নতুন রাজধানী শহর পরিদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়নি কাউকেই। প্রাথমিকভাবে এই শহরে সরকারের সংসদভবন, সাংসদ এবং সরকারি কর্মীদের থাকার বন্দোবস্ত হবে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে স্থাপিত হবে জনবসতি। 

অবশ্য ইন্দোনেশিয়া সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন পরিবেশবিদদের একাংশ। কারণ, জাকার্তা প্রাকৃতিক দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সংবেদনশীল অঞ্চল। এই দ্বীপে সবমিলিয়ে বসবাস প্রায় ১০০টি আদিবাসী জনজাতি গোষ্ঠীর। পাশাপাশি ওরাংওটাং, সুন্দা লেপার্ড, প্যাঙ্গোলিন, উড়ন্ত কাঠবিড়ালি, হর্নবিল, সিভেট, লেমুর-সহ একাধিক বিপন্নপ্রায় প্রজাতির প্রাণীর বসবাস। তাছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য গাছ-গাছালি। নগর গড়ে উঠলে এই বাস্তুতন্ত্রও প্রভাবিত হবে ব্যাপকহারে, আশঙ্কা পরিবেশবিদদের। তবে ইন্দোনেশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, আগামীতে বিশেষভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হবে এই নতুন শহরে। পাশাপাশি ২০৪৫ সালের মধ্যে কার্বন নির্গম শূন্যে নিয়ে আসা হবে বোর্নিও-র। শহরের মধ্যেও ৬০ শতাংশ বনভূমি বাধ্যতামূলক করবে ইন্দোনেশিয়া। 

সভ্যতার বিকাশের চাপে জাকার্তার এই বিপর্যয় যেন নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে উত্তরাখণ্ডের জোশীমঠের কথা। সতর্ক করছে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং সুপরিকল্পিত নগরায়নের পথে না হাঁটলে ভবিষ্যতে এহেন বিপর্যয়ের শিকার হতে পারে ভারতেরও একাধিক শহর!

Powered by Froala Editor

More From Author See More