আজও যুদ্ধবিধ্বস্ত দিনগুলির সাক্ষ্য বহন করে হুন্দেরমানের ‘স্মৃতির জাদুঘর’

কথায় বলে স্মৃতি সততই সুখের। অতীতের ছায়া ঘেরা মুহূর্তরা ফিরে আসে গল্পে-গানে-আড্ডায়। কথারাই হয়ে যায় ইতিহাস। হৃদয়ের গভীরে তাদের লালন করেই বেঁচে থাকা, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা। কিন্তু স্মৃতিমাত্রেই কি আনন্দের? যাদের দিন কেটেছে যুদ্ধের তীব্রতার মধ্যে, পালাতে হয়েছে বসতবাড়ি ছেড়ে, অতীত কি তাঁদের কাছে যন্ত্রণার নয়? তবুও স্মৃতিকে আদরে জড়িয়ে রাখেন কার্গিলের হুন্দেরমান (Hunderman) গ্রামের মানুষ। তৈরি করেন ‘স্মৃতির জাদুঘর’ (Museum of Memories)। ইতিহাসের চিহ্নগুলিতে লেখা থাকে ফেলে আসা সময়ের কথা। 

কাশ্মীরের কার্গিল জেলার সুরু নদীর তীর ধরে ছোট্ট একটি গ্রাম হুন্দেরমান। ইতিহাসের বহু উত্থানপতনের সাক্ষী। লাইন অফ কন্ট্রোল থেকে বেশি দূরে নয়। স্ট্যানজিন স্যালডনের ‘পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়া’-র মতে স্বাধীনতার পর গ্রামটি চলে যায় পাকিস্তানের অধীনে। ১৯৬৫-তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর প্রায় দেশহীন হয়ে পড়ে গ্রামের ভবিষ্যৎ। অবশেষে ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী পুনরুদ্ধার করে হুন্দেরমানকে। 

‘স্মৃতির জাদুঘর’-এর ইতিহাস খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে সেই যুদ্ধের দিনগুলিতে। যার ফলে বদলে যায় গ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান, বদলায় মানুষের জীবনযাত্রা। মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল হুন্দেরমান। যুদ্ধের সময় নিচু অংশের ঘরবাড়ি ছেড়ে গ্রামবাসীরা আশ্রয় নেন উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে। বহু মানুষ চলে যান পাকিস্তানে। আর ফিরে আসা হয়নি। পুরনো গ্রামটি হয়ে যায় জনশূন্য। আসবাবপত্র, গৃহস্থালির ছোটো ছোটো সরঞ্জাম, ছবি সব পড়ে থাকে পিছনে। নতুন অঞ্চলে শুরু হয় নতুন জীবন।

এখনও সেখানেই থাকেন তাঁরা। প্রবল শীতের হাত থেকে বাঁচতে তৈরি করেছেন কাদা ও পাথরের ঘর। কিন্তু ভোলেননি পুরনো হুন্দেরমানকে। সময়ের সঙ্গে চলতে শিখলেও বারবার নাড়া দিয়ে গেছে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দিনগুলি। ২০১৫ সাল নাগাদ শুরু হয় অগোছালো সম্পদগুলিকে সংরক্ষিত করার কাজ। শতাব্দীপ্রাচীন গ্রামে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য গল্প আর উপকথা জুড়ে যায় ইতিহাসের সঙ্গে। এসে পড়ে যুদ্ধের প্রসঙ্গ। পুরনো চিঠিপত্র, বাসন, কয়েন, যুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক সাজিয়ে রাখেন গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে। এভাবেই গড়ে ওঠে ‘স্মৃতির জাদুঘর’। 

আরও পড়ুন
কাশ্মীরে বিপন্নপ্রায় ফার্সি, সংরক্ষণের হাতিয়ার কবির পাণ্ডুলিপি

উপযুক্ত পরিবহণের অভাবে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্নপ্রায় ছিল গ্রামটি। তবে সম্প্রতি বেড়েছে যোগাযোগ। ক্রমে পাচ্ছে পর্যটনকেন্দ্রের তকমা। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে বদলাতে থাকে হুন্দেরমানের গ্রাম্যশোভার রূপ। নিরিবিলি পাহাড়ি সৌন্দর্যের জন্য আসেন অনেক পর্যটক। সঙ্গে নিয়ে যান ‘স্মৃতি’-র মায়াবী স্পর্শ। মানুষ তো আসলে ভুলতে চায় দুর্বিষহ দিনগুলিকে। হৃদয়ের ‘জাদুঘর’-এর সাজিয়ে রাখতে চায় রূপকথার গল্প। হুন্দেরমান আলাদা। যুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা, স্বজন হারানোর ব্যথাকে তারা পরিণত করেছে ইতিহাসে। মায়াকাজল চোখে দেখছে নতুন ভবিষ্যতের আশা।  

আরও পড়ুন
বাজার ছেয়েছে সস্তা ইরানি আপেলে, সিঁদুরে মেঘ দেখছেন কাশ্মীরের কৃষকরা

Powered by Froala Editor