'বিশ্বের সর্বাধিক চুম্বিত নারী' ও একটি মৃত্যুর গল্প

টেবিলের ওপর শুয়ে রয়েছেন এক তরুণী। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আরও কিছু মানুষ। একে একে তাঁর ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে চুম্বন করে যাচ্ছেন তাঁরা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। 

চুম্বনে আগ্রহী নন, এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। কিন্তু চুম্বন নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা? নৈব নৈব চ। একুশ শতকে দাঁড়িয়েও আমাদের সমাজে চুম্বন আজও একটা ট্যাবু। ফলে, এমন দৃশ্য দেখলে তাকে ‘অশ্লীল’ তকমা দেওয়াই স্বাভাবিক অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে। তবে এই দৃশ্যে অশ্লীলতার ছাপ নেই বিন্দুমাত্র। প্রথমত, চুম্বন ভেবে যা ভুল করছেন, তা আসলে মাউথ টু মাউথ সিপিআর বা কার্ডিওপালমোনারি রেসিসিটেশন। আর যাঁরা চুম্বন করছেন, তাঁরা সকলেই চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র-ছাত্রী। দ্বিতীয়ত, টেবিলে শায়িত মানবদেহটির মধ্যে প্রাণ নেই। আদতে তা মানব সদৃশ একটি পুতুল মাত্র। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যকর বিষয় হল, এই মহিলাই বিশ্বের সর্বাধিক চুম্বিত ব্যক্তি। 

ব্যাপারটা একটু ঘোলাটে লাগছে নিশ্চয়ই? আসলে পুতুল হলেও, এই মানব প্রতিকৃতি তৈরি হয়েছে বাস্তবের এক নারীর আদলেই। যাঁর পরিচয় ‘লা’ইনকনু ডে লা সেন’। কেউ আবার তাঁকে ডাকেন ‘মোনালিস অফ সেন’ (Mona Lisa Of Seine) বা ‘রেসুসি অ্যান’ নামে। 

সেই গল্পেই ফেরা যাক বরং। তার জন্য পিছিয়ে যাওয়া যাক ১৪০ বছর। ১৮৮০-র দশকের শেষ দিক সেটা। ফ্রান্সের সেন নদীতে ভেসে উঠল এক বছর ষোলোর নারীর মৃতদেহ। না, শরীরে কোনো ক্ষতচিহ্ন নেই। অর্থাৎ, হত্যাকাণ্ড নয়। বরং আত্মহত্যা। তবে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তো মৃত্যুর নিদান দেওয়া সম্ভব নয়। তাই তাঁর মরদেহ প্যারিসের মর্গে পাঠানো হল ফরেন্সিক রিপোর্টের জন্য। 

আরও পড়ুন
ভেনেজুয়েলার হারাতে-বসা অরণ্যকে বাঁচাচ্ছেন উপজাতি মহিলারা

রিপোর্ট এল ঠিকই। কিন্তু কিশোরীটিকে চিহ্নিত করতে পারলেন না প্যারিসের দুঁদে গোয়েন্দারা। তবে সেই ফাঁকে আরও একটি কাণ্ড ঘটিয়ে বসলেন প্যারিস মর্গের প্যাথোলজিস্ট। কিশোরীটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁর মুখের ছাঁচ তুলে রাখলেন প্লাস্টার অফ প্যারিসে। অল্পদিনের মধ্যেই সেই ছাঁচই বিশ্ববিখ্যাত করে তুলল প্রয়াত কিশোরীটিকে। 

আরও পড়ুন
কাশ্মিরের প্রথম মহিলা হুইলচেয়ার বাস্কেটবল খেলোয়াড়, স্বপ্ন দেখাচ্ছেন বাসির

প্যারিস সংস্কৃতির শহর। ছবিই হোক কিংবা ভাস্কর্য— শিল্প চিরকালই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে প্যারিসের নাগরিকদের। প্লাস্টার অফ প্যারিসের ছাঁচে গড়া সেই কিশোরীর মূর্তিটিও দৃষ্টি আকর্ষণ করল নগরবাসীর। তার আদলেই তৈরি হতে থাকল অসংখ্য মূর্তি। লেখক অ্যালবার্ট কামু মোনালিসার সঙ্গে তুলনা করে তাঁর একটি লেখায় এই মূর্তিটিকে আখ্যা দিলেন ‘দ্য ড্রাউন্ড মোনালিসা’। কেউ আবার নাম দিলেন ‘লা’ইনকনু ডে লা সেন’। যার অর্থ, ‘সেন নদীর অজ্ঞাত পরিচয় যুবতী’। শুধু ফ্রান্স নয়, তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা ইউরোপেই। এমনকি উনিশ দশকের শেষে জার্মান মডেলরাও সাজতেন ‘রেসুসি অ্যান’-খ্যাত এই মূর্তির আদলেই। 

আরও পড়ুন
চাকরি ছেড়ে শিশু ও মহিলাদের জন্য লড়ছেন সাংবাদিকা

কিন্তু কীভাবে সিপিআর মডেল হয়ে উঠল রেসুসি অ্যান? এবার সেই প্রসঙ্গে ফেরা যাক। এটা আরও বছর পঞ্চাশেক পরের ঘটনা। সময়টা ১৯৫০-এর দশক। সিপিআর পদ্ধতির জন্ম দিলেন অস্ট্রিয়ান চিকিৎসক পিটার সাফার এবং তাঁর সহকর্মীরা। চিকিৎসা বিজ্ঞানে পাঠ্যক্রমে সিপিআরের প্রশিক্ষণও বাধ্যতামূলক করা হল অস্ট্রিয়ায়। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ল গোটা বিশ্বেই। 

কিন্তু সেখানে সমস্যা হয়ে দাঁড়াল চুম্বন। আজ থেকে ৭০ বছর আগে চুমু নিয়ে ছুৎমার্গ ঠিক কতটা ছিল, তা নিয়ে আলাদা করে বলার দরকার পড়ে না নিশ্চয়ই? তাই বিকল্প খুঁজতেই ম্যানিকুইন তৈরির কথা চিন্তাভাবনা করলেন মার্কিন চিকিৎসকরা। দায়িত্ব দেওয়া হল নরওয়ের খেলনা প্রস্তুতকারক বাণিজ্যপতি অ্যাসমান্ড লেরডালের কাঁধে। 

মজার বিষয় হল, অ্যাসমান্ডের পূর্বপুরুষ প্যারিস সফরে গিয়ে সংগ্রহ করেছিলেন ‘দ্য ড্রাউন্ড মোনালিস’ অর্থাৎ রেসুসি অ্যানের একটি আবক্ষ মূর্তি। যা হাত ঘুরে পৌঁছেছিল তাঁর কাছে। সেই মূর্তির আদলেই রবারের তৈরি প্রমাণ আকারের মানব মূর্তি নির্মাণ করলেন তিনি। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রেসুসি অ্যানের মূর্তি ও সৌন্দর্যের জনপ্রিয়তা ফিকে হয়েছে অনেকটাই। কিন্তু শতাব্দী পেরিয়ে আজও সিপিআর মডেলের মধ্যে দিয়েই দিব্যি বেঁচে রয়েছে ‘সেন নদীর অজ্ঞাত পরিচয় যুবতী’। আজও তাঁর আদলে তৈরি ম্যানিকুইন ব্যবহৃত হয় সিপিআর প্রশিক্ষণের কাজে। আর সেই সূত্রেই তাঁর পরিচয়ের তালিকায় জুড়েছে আরও একটি নাম। ‘দ্য মোস্ট কিসড গার্ল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ বা বিশ্বের সর্বাধিক চুম্বিত নারী…

Powered by Froala Editor