ইস্টবেঙ্গলে যাওয়া আটকাতে ‘অপহরণ’ করা হয়েছিল সুরজিৎ-কে

মাঝমাঠ থেকে দ্রুত স্প্রিন্ট টেনে। তারপর কয়েকটা পাস। বল তখনও ঘোরাঘুরি করছে সাইডলাইন আর কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে। অন্যদিকে বক্সের মধ্যে ভেসে আসা ক্রসের অপেক্ষা। হ্যাঁ, ক্রস উঠল ঠিকই। তবে সতীর্থ কিংবা বিপক্ষের সমস্ত খেলোয়াড়েরই নাগালের বাইরে। মাথার অনেক উপর দিয়ে বাঁক নিয়ে সরাসরি জালে জড়িয়ে গেল বল। 

১৯৭৯-এর ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড সেমিফাইনাল ম্যাচ সাক্ষী ছিল এই অমোঘ দৃশ্যের। আর তার নেপথ্যে ছিলেন কলকাতা ময়দানের এক ম্যাজিশিয়ান— সুরজিৎ সেনগুপ্ত (Surajit Sengupta)।

১৯৫১ সালে হুগলিতে জন্ম কিংবদন্তি সুরজিৎ সেনগুপ্তর। সদ্য দেশভাগ হয়েছে তখন। ঘটি-বাঙালের বিভেদ এপার বাংলার সর্বত্রই। আর তিনিও যে পূর্ববঙ্গের মানুষ। তারওপর ঘটি পাড়াতে বেড়ে ওঠা। কাজেই খুব একটা সহজ ছিল না লড়াইটা। শুরু থেকে যেন বৈষম্যের প্রাচীর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর সামনে। কিন্তু কে জানত, এই ছেলেই একদিন ময়দান কাঁপাবে কলকাতার তিন প্রধানের হয়েই?

দু’পায়ে শট করার দক্ষতা, স্প্রিন্ট এবং স্কিল— একজন আদর্শ ঘাতক উইংগার হতে যা যা শর্ত, তার প্রত্যেকটিই হাজির ছিল সুরজিতের প্লেইং স্টাইলে। আর সেটাই নজর কাড়ে ফুটবলার তথা প্রশিক্ষক অচ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁর পরিচর্যাতেই পেশাদার ফুটবল জগতে আত্মপ্রকাশ সুরজিতের। সেটা সত্তরের দশকের শুরু দিক। খিদিরপুর ক্লাব সই করালো তাঁকে। লিগের ম্যাচে জাত চেনালেন সুরজিৎ। আর তারপরই তাঁকে নিয়ে শুরু হল ইস্ট-মোহনের রেষারেষি। 

আরও পড়ুন
আইরিস ক্লাবের জার্সিতে বব মার্লের হাস্যমুখ, ফুটবলের সঙ্গে হাত মেলাল সঙ্গীত!

’৭২-এ মোহনবাগান তাঁবুতে যোগ দেন সুরজিৎ। দু’বছর খেলার পর দলবদল। এবার স্বপ্নের লাল-হলুদ ব্রিগেড। তবে তার আগেই ঘটে গেল বিপত্তি। সুরজিতের ইস্টবেঙ্গল-যোগ আটকাতে রীতিমতো তাঁকে ‘অপহরণ’ করলেন মোহন কর্তা। রোভার্স কাপের দল থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন ডায়মন্ডহারবারের এক বাগানবাড়িতে। এদিকে বেপাত্তা সুরজিতের খোঁজে ততক্ষণে থানায় ডায়েরি হয়ে গেছে। 

আরও পড়ুন
ফুটবল ক্লাবের নাম ‘বেঙ্গল’, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও রাজত্ব বাঙালিদের?

না, তাঁর ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেওয়া আটকাতে পারেনি কেউ-ই। বলতে গেলে তারপরই কলকাতার ফুটবল পরিমণ্ডলে সোনার অক্ষরে নাম ওঠে তাঁর। ইস্টবেঙ্গলের হয় টানা ৬ বার কলকাতা লিগ-জয়, ঐতিহাসিক ৫-০ ডার্বিজয়— একের পর এক ইতিহাস রচনা করেছেন সুরজিৎ। সেইসঙ্গে শিল্ডের সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ তো আছেই। সেবারেও তাঁর কাছে স্বয়ং দেবদূত হয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন কৈশোরের কোচ অচ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের অনুশীলন না হলেও, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাম ঝরিয়েছিলেন তাঁর কাছেই। তারপরেই ম্যাজিক। পাশাপাশি জাতীয় দলের জার্সিতেও ফুটবল মাঠে দাপিয়েছেন সুরজিৎ। 

আরও পড়ুন
প্রয়াত ভারতীয় ফুটবলের ‘চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া’ নভি কাপাডিয়া

কিন্তু খেলাতেও সাফল্যের ওপরে অবস্থান রাজনীতির। আর সেটাতেই যেন খুব একটা সড়োগড়ো ছিলেন না কিংবদন্তি উইঙ্গার। যে ইস্টবেঙ্গলের স্বর্ণযুগের নায়ক তিনি, ফলস্বরূপ সেই দলই ছাড়তে হল তাঁকে। ১৩ জন সতীর্থকে নিয়ে যোগ দিলেন মহামেডান এফসিতে। বছর দুয়েক পরে ফের মোহনবাগান। সেখানেও প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াল ফের রাজনীতি। ক্লাব কর্তাদের সঙ্গে মনোমালিন্য, মতের অমিল। না, বাক-বিতণ্ডায় জড়াননি তিনি। বরং, নীরবেই সরে গিয়েছিলেন ফুটবল জগৎ থেকে। চাইলে আরও বেশ কয়েক বছর টিকে থাকতে পারতেন ময়দানে। কিন্তু, বুটজোড়া তুলে রেখেই নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সুরজিৎ। 

গোলের পরিসংখ্যান নয়, বরং শিল্পই ছিল তাঁর খেলার মূলমন্ত্র। মাত্র ১২ বছরের ফুটবল কেরিয়ারে এমন নজর কাড়া সাফল্যের অধিকারী আর কজন বাঙালিই বা হতে পেরেছে? সেই কারণেই হয়তো বিপক্ষের কোচ হওয়া সত্ত্বেও পিকে-র মতো ব্যক্তিত্বের থেকে প্রশংসা আদায় করে নিয়েছিলেন সুরজিৎ। পেয়েছিলেন শাসন, স্নেহ। সুরজিতের চলে যাওয়ায় ইতি পড়ল ময়দানের সেই সোনায় বাঁধানো দিনলিপিতে…

তথ্যসূত্রঃ
দলবদলের সময় অনশনে সুরজিৎ, শৈলেন মান্নার নামে এফআইআর, অনির্বাণ মজুমদার, আনন্দবাজার পত্রিকা

Powered by Froala Editor