ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বর্বরতাকে প্রকাশ্যে এনেছিলেন যিনি

১৯৬৪ সাল। তখনও পর্যন্ত দুটি খণ্ডে বিভক্ত ভিয়েতনাম। কমিউনিজমের প্রভাবে প্রভাবিত উত্তর ভিয়েতনাম। অন্যদিকে দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত নদেম দিয়েনের সরকার। এমন সময় প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত তিনটি মার্কিন জাহাজের ওপর উত্তর ভিয়েতনামের বন্দর থেকে হামলা করা হয় বলে দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র। তারপরই ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। সবমিলিয়ে পাঠানো হয়েছিল প্রায় ৫ লক্ষ সৈন্য। অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার এবং বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত করা হয়েছিল উত্তর ভিয়েতনামকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে ঘাতক ও বর্বর যুদ্ধ হিসাবেও অনেকে চিহ্নিত করে থাকেন এই দ্বন্দ্বকে। অথচ, এই যুদ্ধের শুরু হয়েছিল যে-জাহাজডুবির ঘটনা দিয়ে, সেই ঘটনাটিই ছিল সম্পূর্ণ সাজানো। 

১৯৭১ সালে প্রকাশ্যে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা হেডকোয়ার্টার পেন্টাগনের বেশ কিছু গোপন নথি (Pentagon Papers)। গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অন্ধকার সত্যি। এই নথিগুলির দৌলতেই শেষ অবধি ইতি পড়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে। পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। পাশাপাশি পতন হয়েছিল রিচার্ড নিক্সনেরও। নেপথ্যে, মার্কিন কূটনীতিবিদ ও যুদ্ধ পরামর্শদাতা ড্যানিয়েল এলসবার্গ (Daniel Ellsberg)। অবশ্য লোকমুখে যিনি পরিচিত ‘হুইসলব্লোয়ার’ নামেই। 

বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসারে ভুগছিলেন তিনি। সেইসঙ্গে থাবা বসিয়েছিল বার্ধক্যও। সম্প্রতি শারীরিক অবস্থার অবনতির জন্য তাঁকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। গতকাল ৯২ বছর বয়সে সেখানেই প্রয়াত হন এলসবার্গ। ইতি পড়ে আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়ে। 

এলসবার্গের কাহিনি কোনো উপন্যাসের থেকে কম নয় কোনো অংশেই। ১৯৩১ সালের ৭ এপ্রিল শিকাগো শহরে জন্ম এলসবার্গের। বড়ো হয়ে ওঠে ডেট্রয়েটের শহরতলিতে। পরিবারের একাধিক সদস্য মার্কিন সেনাবাহিনীতে কাজ করায়, কৈশোর থেকেই তাঁর আগ্রহ ছিল যুদ্ধবিজ্ঞানের প্রতি। বড়ো হয়ে নিজেও যোগ দিয়েছিলেন ‘মেরিন কর্পস’ সেনাবিভাগে। পরবর্তীতে হার্ভার্ড থেকে যুদ্ধবিদ্যা ও প্রতিরক্ষার ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন এলসবার্গ। সেই সুবাদেই যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগনে পা রাখা তাঁর। ১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিকে হয়ে উঠেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র-কৌশল ও যুদ্ধ-পরিকল্পনার অন্যতম পরামর্শদাতা। 

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ‘দেশপ্রেমী’ এলসবার্গ কেন শেষ পর্যন্ত নিজের দেশের অন্ধকার সত্য প্রকাশ্যে এনেছিলেন? কেন ফাঁস করেছিলেন গোপন নথি? আসলে ষাটের দশকের শেষের দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের মূল্যায়নের দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। সে-সময় একাধিক রিপোর্ট এবং সমীক্ষায় তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ভিয়েতনামে কাতারে কাতারে মারা যাওয়া মানুষদের অধিকাংশই নিরস্ত্র এবং নিরীহ। পাশাপাশি নাপাম বোমার মতো বিধ্বংসী যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহারেরও বিরোধিতা করেন এলসবার্গ। তবে তাতে লাভের লাভ হয়নি কিছুই। সিদ্ধান্তে অটল ছিল মার্কিন প্রশাসন। 

এলসবার্গ বুঝেছিলেন, এত সহজে এই যুদ্ধের ইতি হওয়া সম্ভব নয়। কমিউনিজমের ‘ডমিনো এফেক্ট’ রুখতে বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি গোটা উত্তর ভিয়েতনামকেই মুছে ফেলতে পারে মানচিত্র থেকে। সেক্ষেত্রে একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষই ইতি টানতে পারে এই বর্বরতা, নৃশংসতার। জনসমর্থন না পেলে শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হবে মার্কিন প্রশাসন— এমনটাই ধারণা ছিল তাঁর। 

হয়েওছিল তেমনটাই। ১৯৭১ সালে পেন্টাগনের ৭০০০ পাতার গোপন নথির অনুলিপি তৈরি করে তিনি তুলে দেন দুটি ভিন্ন ভিন্ন সংবাদমাধ্যমের হাতে। তারপরই দেশজুড়ে সাড়া পড়ে যায় ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে। এই ‘দেশদ্রোহিতা’-র জন্য ‘আমেরিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি’ হিসাবে তাঁকে চিহ্নিত করেছিল মার্কিন প্রশাসন। এলসবার্গকে গ্রেপ্তার হতে হয় এফবিআই-এর হাতে। তাঁর নামে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হয় মামলা-ও। তবে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের বিরুদ্ধেই রায় যায় আদালতের। 

জীবদ্দশায় একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, কখনও কখনও যুদ্ধের, বীভৎসতার ইতি টানতে জাত্যাভিমান ছেড়ে সত্যের পথেও হাঁটতে হয়। এই ‘অপরাধ’-এর জন্য মৃত্যুদণ্ড হলেও কোনোরকম আক্ষেপ থাকত না তাঁর। এমনকি ২০২৩ সালে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ সংক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার সময়ও তিনি দাবি করেছিলেন, এটাই যুদ্ধ থামানোর একমাত্র পথ। যুদ্ধপিপাসুদের জন্য সতর্কবার্তা। সবমিলিয়ে পশ্চিমা কপটতাকে বার বার বিশ্বের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন ‘হুইসলব্লোয়ার’। এমন আশ্চর্য বর্ণময় দ্বিতীয় কোনো চরিত্র পৃথিবীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর।

Powered by Froala Editor