হিমালয়ের বুকে লুকিয়ে ঘাতক পারমাণবিক যন্ত্র! ত্বরান্বিত করছে হিমবাহের গলনকে?

গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় ভয়াবহ তুষারধ্বস গ্রাস করে নিয়েছিল ধৌলিগঙ্গার দু’ধারের বেশ কয়েকটি গ্রাম। ভাঙন ধরেছিল বাঁধে। সেইসঙ্গে প্রাণ হারিয়েছিলেন দুই শতাধিক মানুষ। প্রকাণ্ড হিমবাহের কিয়দাংশ খসে পড়ার কারণ হিসাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল জলবায়ু পরিবর্তন ও পার্বত্য এলাকায় অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকে। কিন্তু যদি বলা হয়, এই ধ্বসের পিছনে পরোক্ষভাবে দায়ী তেজস্ক্রিয় পারমাণবিক বিকিরণ?

অবাক লাগছে নিশ্চয়ই? সেটাই স্বাভাবিক। তবে চামোলি দুর্ঘটনার পর উঠে এসেছিল এমন এক তত্ত্ব। অবশ্য তত্ত্ব বলা ভুল হবে। কারণ, তাঁর এই অনুমান যে একশো শতাংশ সত্য, তা জোর গলায় দাবি করেননি অভিযোগকারী। বরং, জানিয়েছিলেন উত্তরাখণ্ডের নন্দাদেবী (Nanda Devi) পর্বতে লুকিয়ে রয়েছে পারমাণবিক জ্বালানি (Nuclear Fuel) বোঝাই একটি যন্ত্র। সতর্ক করেছিলেন, তা থেকে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে বিকিরণ। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি নিয়ে তদন্তের আর্জিও জানান তিনি। 

ক্যাপ্টেন মনমোহন সিং কোহলি (Captain Manmohan Singh Kohli)। চামোলি দুর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সংক্রান্ত তাঁর অনুমান ভুল হলেও হতে পারে, তবে নন্দাদেবীর তুষারের চাদরে লুকিয়ে থাকা পারমাণবিক যন্ত্রটির উপস্থিতির ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্ভুল তিনি। কারণ, নন্দাদেবীর গুহায় এই যন্ত্র রেখে এসেছিলেন তিনি নিজেই। হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি! কিন্তু কেন বরফের নিচে লুকিয়ে রাখা হল এমন একটি ভয়ঙ্কর ঘাতক অস্ত্র? শুরু থেকেই বলা যাক সেই গল্প… 

১৯৬৫ সাল সেটা। ভারত-চিন যুদ্ধের পর পেরিয়ে গেছে তিন-তিনটি বছর। ভারতের আকসাই চিনের দখল নিয়েছে রেড আর্মি। সেই ক্ষত শুকিয়ে ওঠার আগেই খবর আসে তিব্বতের বিরান এলাকায় নিউক্লিয়ার টেস্ট বেস তৈরি করেছে চিন। অর্থাৎ, ষাটের দশকে রাশিয়ার সাহায্যে যে পরমাণু বোমার ফর্মুলা পেয়েছিল চৈনিকরা, তা দিয়েই তারা বানিয়ে ফেলেছে পরমাণু অস্ত্র। এবার শুরু হবে তার পরীক্ষানিরীক্ষা। চিনের এই শক্তিবৃদ্ধিতে একদিকে যেমন আতঙ্কিত ছিল ভারত, তেমনই এশিয়ায় নতুন শক্তির উত্থান আমেরিকার কাছেও ছিল হুমকি-সম। কারণ, মার্কিন মুলুক ও সোভিয়েতের মধ্যে সে-সময় ঠান্ডাযুদ্ধ চলছে পুরোদমে। 

ষাট ও সত্তর দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার ঘনিষ্ঠতম ‘বন্ধু’ ছিল পাকিস্তান। এমনকি ভারত-পাক যুদ্ধের সময়ও একাধিকবার পাকিস্তানের পাশেই দাঁড়িয়েছে আমেরিকা। সরবরাহ করেছে ঘাতক যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক কিংবা সাবমেরিন। তা সত্ত্বেও চিনকে দমানোর জন্য ১৯৬৫ সালে সাময়িকভাবে ভারতের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উত্তর ভারত থেকে চিনের পরমাণু পরীক্ষার ওপর নজরদারি চালাতে যৌথ অভিযানে নেমেছিল ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো এবং আমেরেইকার সিআইএ। 

‘মিশন নন্দাদেবী’। হ্যাঁ, এমনই নাম ছিল সেই অভিযানের। কে-২ এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার পর নন্দাদেবীই ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। এবং, এই শৃঙ্গ সম্পূর্ণভাবে ভারতের সীমানার মধ্যে অবস্থিত। তাই নজরদারির জন্য এই শৃঙ্গকেই বেছে নিয়েছিলেন মার্কিন গোয়েন্দারা। কিন্তু কীভাবে চলবে এই নজরদারি?

না, দূরবীন কিংবা রাডারের মাধ্যমে নয়; পারমাণবিক কার্যকলাপ নজরদারি করতে সিআইএ নিয়ে এসেছিল ইউরেনিয়াম এবং প্লুটোনিয়াম চালিত একটি বিশেষ যন্ত্র। এই যন্ত্র যেমন দূর থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ চিহ্নিত করতে সক্ষম, তেমনই ইউরেনিয়ামের মাধ্যমে দুর্গম অঞ্চলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম তা। ঠিক হয় নন্দাদেবী পর্বতের শিখরে রেখে আসা হবে এই যন্ত্রটিকে। তবে প্রায় আট হাজার মিটার উচ্চতায় আরোহণের জন্য, তখনও পর্যন্ত উপযুক্ত হেলিকপ্টার নেই ভারতে। অন্যদিকে আমেরিকা থেকে এমন হেলিকপ্টার আনতে গেলে, সহজেই তা নজর পড়ে যাবে রাশিয়া ও চিনের। তবে উপায়? শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, পর্বতারোহীর ছদ্মবেশে মার্কিন ও ভারতীয় গোয়েন্দারা ৫৮ কেজি ওজনের এই যন্ত্রটিকে রেখে আসবেন নন্দাদেবীর শিখরে। সেই সঙ্গে নিয়ে যাওয়া দুটি ট্রান্সমিটার সেট এবং ১০ ফুট লম্বা একটি অ্যান্টেনা। এই দলে দুই দেশের গোয়েন্দা ছাড়াও সামিল হয়েছিলেন ভারতীয় সেনার বেশ কিছু কমান্ডোকে। অবশ্য ক্যাপ্টেন মনমোহন সিং কোহলি ছাড়া আর কেউ-ই জানতে না এই যন্ত্রের মধ্যে আদতে কী সঞ্চিত রয়েছে। 

১৯৬৫ সালের অক্টোবর মাস সেটা। চামোলি দিয়েই নন্দাদেবীর দিকে পাড়ি দিয়েছিল ১৩ জন গোয়েন্দা ও সেনার এই বিশেষ দলটি। তার মাস দুয়েক আগেই তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল আলাস্কার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট ম্যাককেনলিতে। তবে হিমালয়ের ভূপ্রকৃতি আলাস্কার থেকেও বহুগুণ বিপজ্জনক এবং দুর্গম। ফলে, এই কঠিন পথে ৫৮ কেজি ওজনের যন্ত্র পিঠে নিয়ে পর্বতারোহণ আরোই চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে তাঁদের পক্ষে। সাথ দেয়নি ভাগ্যও। ১৮ অক্টোবর। শিখরে পৌঁছাতে তখনও দেড় হাজার মিটার বাকি। ভয়াবহ তুষার ঝড়ের শিকার হয় গোয়ান্দাদের দলটি। সেইসঙ্গে তীব্র ঠান্ডায় ফুসফুসে জল জমে অসুস্থ হয়ে পড়েন দুই সেনা। বাধ্য হয়েই তাই বেস ক্যাম্পে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন ক্যাপ্টেন মনমোহন সিং। আর সেই যন্ত্র?

না, সেটি সঙ্গে নিয়ে ফেরা সম্ভব ছিল না কোনোভাবেই। নন্দাদেবীর এক গুহায় যন্ত্রটি লুকিয়ে রেখে এসেছিলেন মনমোহন সিং। এর প্রায় মাস ছয়েক পর, ১৯৬৬ সালে ফের নন্দাদেবী অভিযানে পাঠানো হয় ১৩ জনের এই দলটিকে। এবারে ঘটে যায় আরও আশ্চর্যজনক এক ঘটনা। নন্দাদেবীর সেই গুহা থেকে উধাও পারমাণবিক শক্তিচালিত সেই যন্ত্র! তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছিল যন্ত্রটিকে। তবে ব্যর্থ হয়েই ফিররতে হয়েছিল ক্যাপ্টেন মনমোহন সিং-কে। 

দীর্ঘদিন গোপনে তদন্ত চলেছিল ‘মিশন নন্দাদেবী’ নিয়ে। তবে আখেরে লাভ হয়নি কিছুই। মার্কিন গোয়েন্দাদের অভিমত, চুরি হয়ে গিয়েছিল যন্ত্রটি। অন্যদিকে আইবি এবং মনমোহন সিং-এর বিশ্বাস ছিল, সেটি আজও লুকিয়ে রয়েছে নন্দাদেবীর তুষারের তলায়। তুষার ঝড় কিংবা হিমবাহের ধ্বসের কারণে তা গুহা থেকে বেরিয়ে এসেছিল বলেই অনুমান তাঁর। আজও যা ধীর গতিতে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়ে চলেছে নন্দাদেবীতে। হয়তো সেই কারণেই ২০২১-এর চামোলি দুর্ঘটনা…

আর চিনের কার্যকলাপ নিরীক্ষণের মিশন? ১৯৬৮ সালে আবার একটি নতুন যন্ত্র তৈরি করে স্থাপন করা হয় নন্দাদেবীর পার্শ্ববর্তী নন্দকোট পর্বতে। ছ’মাস ধরে যা নজরদারি চালিয়েছিল চিনের নিউক্লিয়ার টেস্টবেসে। না, এবারে আর ভুল হয়নি কোনো। অত্যন্ত সতর্কভাবেই তা নামিয়ে আনা হয় নজরদারি চালানোর পর।

১৯৯৮ সালেই পোখরান পরীক্ষার পর পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ভারত। আজ পরমাণু প্রযুক্তিতে পশ্চিমি দুনিয়াকেও টক্কর দিতে সক্ষম আমাদের দেশ। তা সত্ত্বেও, হিমালয়ের বরফের চাদরে লুকিয়ে থাকা এমন ঘাতক একটি যন্ত্রের অনুসন্ধানে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকার? বছর দেড়েক আগে এমনটাই প্রশ্নই তুলেছিলেন ক্যাপ্টেন মনমোহন সিং কোহলি…

Powered by Froala Editor

Latest News See More