পণ্ডিচেরির বুকে সংরক্ষিত অরণ্য, নেপথ্যে ইজরায়েলি দম্পতি

ইজরায়েলের (Israel) রাজধানী তেল আবিব। সেখানেই চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক যন্ত্র তৈরির ব্যবসা ছিল তাঁর। আয় কম ছিল না মোটেই। তবে, দৈনন্দিনের ব্যস্ততা, একঘেঁয়ে শহুরে জীবন আর দূষণ অতিষ্ঠ করে তুলেছিল তাঁকে। তাই কয়েকদিনের ছুটি কাটাতেই স্ত্রী-কে ভারতে ঘুরতে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু তখন আর কে-ই বা জানতে যে ইজরায়েল ছেড়ে, এ-দেশেরই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে উঠবেন তিনি?

আভিরাম রোজিন ও ইওরিট রোজিন। ১৯৯৮ সালে প্রথমবার ভারতে পর্যটনে এসেছিলেন এই ইজরায়েলি দম্পতি (Rozin Couple)। বলাই বাহুল্য, শস্যশ্যামলা ভারতের মায়া কাটাতে পারেননি দু’জনেই। বিশেষ করে তাঁদের আকৃষ্ট করেছিল পণ্ডিচেরির ‘অরোভিল’ (Auroville) শহর। ঋষি অরবিন্দের নামাঙ্কিত এই শহরেই মিলেমিশে বসবাস করেন অন্ততপক্ষে ৭০টি দেশের নাগরিকরা। সকলের জীবনের উদ্দেশ্য একটাই, একে অন্যের পাশে দাঁড়ানো, পরিবেশ ও সমাজকে ‘দূষণমুক্ত’ করে তোলা। 

অরোভিলের এই পরিবেশই ভাবিয়ে তোলে রোজিন দম্পতিকে। চলতি শতকের গোড়ার দিকে, ভারতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তাঁরা। লক্ষ্য ছিল, তামিলনাড়ুর হারিয়ে যাওয়া অরণ্য উদ্ধার করা। ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে অরোভিল সংলগ্ন ৭০ একর জমিতে এই প্রকল্পের সূচনা করেন আভিরাম ও ইওরিট। তবে শুধু বনায়নই নয়, তামিলনাড়ু প্রতিবছর খরার শিকার হওয়ায়, জল সংরক্ষণেও বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন রোজিন দম্পতি। 

আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না, বিগত দু’দশকে সমগ্র অঞ্চলের চেহারা বদলে দিয়েছেন আভিরাম ও ইওরিট। একটা সময় যা ছিল পরিত্যক্ত, শুকনো জমি; আজ সেখানেই ছড়িয়ে রয়েছে সবুজ গাছগাছালির শামিয়ানা। সেখানে অবাধ বিচরণ ময়ূর, শেয়াল, খেঁকশিয়াল, বন্য শূকর, খরগোশ, সিভেট বিড়াল-সহ একাধিক প্রাণীর। 

প্রাথমিকভাবে আভিরাম ও তাঁর স্ত্রী এই প্রকল্প শুরু করলেও, বছর কয়েক পর থেকেই তাঁদের সঙ্গে এই কাজে হাত লাগিয়েছিলেন জনা কুড়ি স্বেচ্ছাসেবক। তাঁরাও অরোভিলেরই বাসিন্দা। সেইসঙ্গে বাড়তে বাড়তে বর্তমানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে কয়েকশো-তে। গাছের চারা তৈরি থেকে শুরু করে, অরণ্যের পরিচর্যা, জলসংরক্ষণ— সবটার দায়িত্বই নিজে থেকে কাঁধে তুলে নিয়েছেন তাঁরা। অভিরামের কথায়, প্রকৃতি পুনরুদ্ধারের এই উদ্যোগে অবলা পশু-পাখিদের ভূমিকাও কম নয়। তাঁর অভিমত, এই অরণ্যে ময়ূর ও অন্যান্য পাখি ফিরত আসার পর প্রাকৃতিকভাবেই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে পরিবেশ। কারণ ব্যাখ্যা করতে তিনি তুলে আনছেন ডারউইনের ‘ন্যাচরাল সিলেকশন’-এর তত্ত্ব। এ-কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই, বাস্তুতন্ত্রের সমীকরণ ফিরে এসেছে বলেই সেরে উঠছে প্রকৃতি। 

তবে এখানেই শেষ নয়। রোজিন দম্পতির উদ্যোগে বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক অদ্ভুত সম্পর্কও। সংঘাত তো নয়ই, বরং এহেন সহাবস্থানের ছবি নিজেরা কোনোদিন স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি বলেই দাবি তাঁর। ‘সাধনা বন’-খ্যাত এই সংরক্ষিত অরণ্যের উদ্যোগ ভারতে সফল হওয়ার পর, বর্তমানে হাইতি এবং কেনিয়াতেও একই ধরনের অরণ্য গড়ে তোলার প্রকল্প নিয়েছেন রোজিন দম্পতি। তবে স্থায়ীভাবে এ-দেশ ছেড়ে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই তাঁদের, এমনটাই জানাচ্ছেন আভিরাম ও ইওলিট…

Powered by Froala Editor