বিলেতের রাজাকে ছাড়িয়ে দরবারের মধ্যমণি যখন দুই ‘কাশ্মীরি দৈত্য’

রাজপথ দিয়ে এগিয়ে চলেছে প্রকাণ্ড শোভাযাত্রা। আর সেই শোভাযাত্রার মধ্যমণি খোদ ব্রিটেনের রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড। সম্পর্কে তিনি সদ্যপ্রয়াত ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রপিতামহ। তাঁরই রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে এত আয়োজন। এই শোভাযাত্রা দেখতে হাজির হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের রাজ-রাজরা, দেশ-বিদেশ থেকে আসা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, চিত্রকাররাও রয়েছেন এই তালিকায়। তবে আশ্চর্যের বিষয়, এই মহামিছিলে রাজাকে ছাড়িয়েও সমস্ত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন দুই ভারতীয়। 

‘দ্য কাশ্মীর জায়েন্টস অফ ইন্ডিয়া’ (The Kashmiri Giants Of India)। ব্রিটেনের তো বটেই, ইউরোপের অন্যান্য সংবাদমাধ্যমেও এই নামেই পরিচিতি পেয়েছিলেন এডওয়ার্ডের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হয়ে ওঠা দুই ভারতীয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বিস্তর লেখালিখিও হয়েছিল তাঁদের নিয়ে। কিন্তু এই দুই ব্যক্তি আদতে কে? খোদ ব্রিটিশ-রাজের সিংহাসন আরোহণের অনুষ্ঠানেই-বা তাঁরা হাজির হলেন কীভাবে? 

১৯০৩ সাল। উইন্ডসর’স ডিউক নামে পরিচিত ব্রিটিশরাজ সপ্তম এডওয়ার্ডের মূল রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল ব্রিটেনে। তবে ব্রিটেনের সম্রাট বলতে শুধু ব্রিটেনেরই নয়, সে-সময় ভারত ব্রিটেনের উপনিবেশ হওয়ায় ভারত শাসনের দায়িত্বও হাতে ওঠে এডওয়ার্ডের। ‘ভারতীয় সম্রাট’-এর উপাধিও দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। কাজেই তাঁর সিংহাসন আরোহণ স্মরণে ভারতের বুকেও বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন। ইতিহাসের পাতায় যে-আয়োজন আজ পরিচিত ‘দিল্লি দরবার’ (Delhi Durbar) নামে। 

বলাই বাহুল্য ‘বর্বর’, ‘কৃষ্ণাঙ্গ’-দের দেশে আয়োজিত রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানে আসার কোনো আগ্রহই ছিল না সপ্তম এডওয়ার্ডের। ফলে কার্জনের প্রস্তাব ও আমন্ত্রণ পত্রপাঠ খারিজ করে দেন সপ্তম এডওয়ার্ড। এদিকে নাছোড় কার্জনও। কার্জনকে ভারতভ্রমণের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলতেই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করেন তিনি। জানান, সেই শোভাযাত্রায় থাকবে নানা চমক, বিস্ময়, আশ্চর্য সব বিনোদনের বন্দোবস্ত। শেষ পর্যন্ত কার্জনের এই আমন্ত্রণে ফিরিয়ে দিতে পারেননি সপ্তম এডওয়ার্ড। 

অবশ্য আকস্মিক এমন একটি ‘ওয়ান্ডার শো’ আয়োজন করা তো মুখের কথা নয়। সবমিলিয়ে গোটা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করতেই প্রায় দেড় বছর সময় লেগেছিল কার্জনের। নতুন করে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল দিল্লিকে। ব্রিটিশ শাসকদের মূল্যবান গ্রহরত্ন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিশালতা ও মাহাত্ম্যকে একই মঞ্চে প্রদর্শিত করা হয়েছিল বিভিন্নভাবে। সেইসঙ্গে আয়োজিত হয়েছিল প্রকাণ্ড হস্তী-মিছিলের। হাতির পিঠে চেপে এই শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের রাজারা। লর্ড কার্জন এবং সপ্তম এডওয়ার্ডও। মণিমাণিক্য ও স্বর্ণখচিত পোশাক পরিয়ে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল এই বিশাল হস্তীবাহিনীকে। পাশাপাশি সম্রাট এডওয়ার্ডের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল দুই দীর্ঘদেহী কাশ্মীরি দেহরক্ষীকে। 

মূলত এই দুই দেহরক্ষীই ছিলেন তৎকালীন কাশ্মীর-রাজের সৈন্য। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে, কাশ্মীরের বালমোকন্দ অঞ্চল থেকেই নাকি এসেছিলেন এই দুই দীর্ঘদেহী দেহরক্ষী। তবে তাঁদের জন্ম আধুনিক ভারতের ম্যাপে ঠিক কোথায়— তা বলা মুশকিল। কারণ, বিগত দেড়শো বছরে একাধিকবার নাম বদলেছে কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকার। সে যাই হোক, এডওয়ার্ডের অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ তলব করে কাশ্মীর থেকে তাঁদের নিয়ে আসা হয়েছিল দিল্লি দরবারে। রাজার হাতির পাশে পাশেই গোটা রাজপথ হেঁটে পার হয়েছিলেন তাঁরা। তৎকালীন নথি অনুযায়ী, দীর্ঘদেহী এই দুই ‘কাশ্মীরি দৈত্য’-এর উচ্চতা ছিল যথাক্রমে ৭ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং ৭ ফুট ৪ ইঞ্চি। আরও মজার বিষয় হল, তাঁরা দুজনেই ছিলেন যমজ ভাই। সে-যুগের সংবাদমাধ্যমে দাবি করে, তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা জীবিত ব্যক্তি ছিলেন নাকি এই দুই ভারতীয়ই। 

অবশ্য শুধুমাত্র রাজার দেহরক্ষী হিসাবেই নয়, এই দুই কাশ্মীরি জায়েন্ট শোভাযাত্রায় হাজির হয়েছিলেন আশ্চর্য সব অস্ত্র নিয়ে। সেই তালিকায় রয়েছে বর্শা, গদা, ম্যাচলক, হ্যান্ড গ্রেনেড ও সে-যুগের উন্নত সব রাইফেল। ফলে আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না রাজা এডওয়ার্ডকে ছাপিয়ে তাঁরাই হয়ে উঠেছিলেন এই শোভাযাত্রার মূল আকর্ষণ। 

শুধু এই অনুষ্ঠানেই নয়, তারপরেও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক এবং ফটোগ্রাফাররা ভিড় জমিয়েছিলেন ভারতে, শুধুমাত্র এই দুই কিংবদন্তিকে সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করার জন্যই। ১৯০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ান প্রকাশনা ‘দ্য ব্রিসবেন কুরিয়ার’-এ তাঁদের নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল আস্ত একটি প্রবন্ধ। ভারতে জন্মেও কীভাবে উচ্চতায় ইউরোপীয়দের থেকে হার মানালেন এই দুই দৈত্য— তা নিয়ে চলেছিল বিস্তর চর্চা। আমেরিকা থেকে সত্যতা যাচাই করতে ভারতে ছুটে এসেছিলেন জেমস রিকল্টন নামের এক ফটোগ্রাফারও। নিজে দুই দৈত্যের মাঝে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলেন তিনি। তাছাড়াও দুই কাশ্মীরি দৈত্যের দৈর্ঘ্যের তুলনা করার জন্য তাঁদের পাশে দাঁড় করিয়ে তুলেছিলেন সাধারণ ভারতীয়, দুই বামন এবং ইউরোপীয়দের ছবি। সে-সময় এই ছবিগুলি আগুনের মতোই ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা পাশ্চাত্যে। 

তবে উচ্চতার নিরিখে এই দুই কাশ্মীরিই যে ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘতম ব্যক্তি, এমনটা নয়। তখনও গিনেস বুক আত্মপ্রকাশ না-করায় সেভাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মেলেনি তাঁদের। পরবর্তীতে তাঁদের উচ্চতাকে ছাপিয়ে গেছেন অনেকেই। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়া দীর্ঘদেহীরাও হয়তো এই দুই কিংবদন্তি মতো জনপ্রিয়তা পাননি বিশ্ববাসীর কাছে।

Powered by Froala Editor

Latest News See More