টেলিপোর্টার আবিষ্কারের দাবি, তারপরই নিখোঁজ ব্রিটিশ উদ্ভাবক!

হিরাম স্টিভেন্স ম্যাক্সিম (Hiram Maxim)। নামটা অনেকেরই পরিচিত। উনিশ শতকের শেষ দিকে কিংবদন্তি এই মার্কিন গবেষকের একটি আবিষ্কারই বদলে দিয়েছিল রণনীতি, যুদ্ধের ময়দানকে। হ্যাঁ, বিশ্বের সর্বপ্রথম বহনযোগ্য স্বয়ংক্রিয় মেশিনগানের আবিষ্কর্তা তিনি। শুধু মেশিন গানই নয়, হেয়ার কার্লিং আয়রন, ইঁদুর ধরার যন্ত্র, বাষ্পচালিত পাম্প-সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর নাম। কিন্তু যদি বলা হয় কিংবদন্তি এই গবেষক আদতে ছিলেন একজন ব্রিটিশ? পরিচয় গোপন করে মার্কিন নাগরিকের বেশে লুকিয়ে ছিলেন তিনি? 

প্রথাগত ইতিহাস বা বিজ্ঞানের পাঠ্যবই এমনটা বলা থাকে না ঠিকই। তবে উনিশ শতকের শেষে এমনই এক আশ্চর্য তত্ত্ব দানা বাঁধতে শুরু করেছিল ইউরোপের বুকে। শুধু তত্ত্ব বললে ভুল হবে খানিক, বরং একাধিক রহস্য যেন ইঙ্গিত দিচ্ছিল হিরাম ম্যাক্সিম আদতে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এক ব্রিটিশ গবেষক। যে-রহস্যের সমাধান মেলেনি আজও। 

শুরু থেকেই বলা যাক ব্যাপারটা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় সেটা ব্রিটেন জুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন উইলিয়াম ক্যান্টেলো (William Cantelo) নামের এক উদ্ভাবক। ক্যান্টেলোর জন্ম ১৮৩৮ সালে ব্রিটেনের আইল অফ উইটে। সাউদাম্পটন ফ্রেঞ্চ স্ট্রিটে একটি দোকান এবং রেস্তোরাঁর মালিক ছিলেন তিনি। আর সেই পানশালার নিচেই ছিল তাঁর ভূগর্ভস্থ আশ্চর্য কর্মশালা। অদ্ভুত সব যন্ত্র নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতেন তিনি। আশ্চর্য আলোকবর্তিকা, হামিং গ্লোবস-সহ অজ্ঞাত সব যুদ্ধাস্ত্রও নাকি তৈরি করেছিলেন ক্যান্টেলো। অবশ্য সাধারণ মানুষ চাইলেই তাঁর এই গবেষণাগার তথা কর্মশালায় প্রবেশ করতে পারতেন না। তার জন্য আগে থেকে নিতে হত অনুমতি। ব্যবসার সূত্রেই গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে সেখানে ক্রেতাদের নিয়ে যেতেন তিনি। তবে বাইরে পথচলতি মানুষ বা রেস্তোরাঁর গ্রাহকরাও অদ্ভুত সব শব্দ শুনতে পেতেন ভূগর্ভস্থ কর্মশালা থেকে। 

১৮৭০-এর দশকের শেষ দিকে ক্যান্টেলোর এই কর্মশালায় যোগ দেন তাঁরা ছেলেরাও। ক্যান্টেলোর দুই সন্তানও ছিলেন পেশাদার ইঞ্জিনিয়ার। ধীরে ধীরে নিজের উদ্ভাবিত যন্ত্রের ব্যবহার এবং তার কার্যকারিতা সন্তানদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ক্যান্টেলো। সেইসঙ্গে শুনিয়েছিলেন দুটি আশ্চর্য যন্ত্রের কথা। কী সেই যন্ত্র? প্রথমটি হল টেলিপোর্টার। যুক্তরাজ্য থেকে এই যন্ত্রের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের ভিন্ন দেশে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। আর দ্বিতীয়টি হল এক বিশেষ ধরনের বন্দুক। যা কার্তুজ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে গুলি চালাতে সক্ষম। এর মধ্যে প্রথমটি নাকি তৈরি করে ফেলেছিলেন ক্যান্টেলো। দ্বিতীয়টির গবেষণা চলছে তখনও। 

১৮৮০ সাল। সন্তানদের এই ঘটনার বিবৃতি দেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান ক্যান্টেলো। অনেকেই জানিয়েছেন, শেষবার তাঁকে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ কর্মশালায় প্রবেশ করতে দেখেছিলেন। আবার অনেকের দাবি, প্রকাশ্যে ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে যান তিনি। কিন্তু যাই হোক না কেন, এই ঘটনার পর পুলিশের খাতায় নাম লেখানো হয় ক্যান্টেলোর। চলে বিস্তর অনুসন্ধান। তবে লাভের লাভ হয়নি কিছুই। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পরেও তাঁর সন্ধান মেলেনি কোথাও। 

এর একবছর পর যুক্তরাজ্যে আস্তানা গাড়েন ৪১ বছর বয়সি মার্কিন গবেষক হিরাম ম্যাক্সিম। এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি প্রকাশ্যে আনেন বিশ্বের প্রথম বহনযোগ্য স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ম্যাক্সিম গান। যাকে আমরা আজ চিনি মেশিন গান নামে। তারপর একের পর এক আশ্চর্য যন্ত্র আবিষ্কার করতে থাকেন ম্যাক্সিম। মাত্র এক দশকের মধ্যেই অন্ততপক্ষে ১০-১৫টি যন্ত্রের পেটেন্ট পান তিনি। এমনকি ম্যাক্সিম এও দাবি করেন যে টেলিপোর্টেশন যন্ত্র নাকি তৈরি করে ফেলেছেন তিনি। 

১৮৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে ম্যাক্সিমের এই দাবিই রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয় যুক্তরাজ্যে। বিশেষত এই ঘটনা রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছিল ক্যান্টেলোর উত্তরসূরিদের। যে আশ্চর্য সব যন্ত্র আবিষ্কারের দাবি করেছিলেন তাঁর বাবা, তা কীভাবে তৈরি করে ফেলতে পারে ভিন্ন এক ব্যক্তি? তা-ও একটি যন্ত্র নয়। পর পর দুটি। তবে কি তাঁদের এই পারিবারিক আবিষ্কার কোনোভাবে চুরি করলেন এই ব্যক্তি? এই সন্দেহ থেকেই ম্যাক্সিমের ব্যাপারে অনুসন্ধানে নামেন ক্যান্টেলোর দুই পুত্র। সেই অনুসন্ধান করতে গিয়ে ম্যাক্সিমের ছবি দেখেই চমকে ওঠেন তাঁরা। ম্যাক্সিমকে দেখতে হুবহু তাঁর বাবার মতোই। 

ম্যাক্সিমের নাগাল পেতে সাদাম্পটন থেকে লন্ডনে পাড়ি দিয়েছিলেন ক্যান্টেলোর সন্তানরা। এমনকি স্টেশনে ম্যাক্সিমকে দেখতে পেয়ে ‘বাবা’ বলে চিৎকারও করেছিলেন তাঁরা। তাতে একবার মুখ ঘুরিয়ে দেখলেও কোনো সাড়া দেননি ম্যাক্সিম। উত্তর না-দিয়েই উঠে গিয়েছিলেন ট্রেনে। এই ঘটনার পর জোরালো দাবি ওঠে, ম্যাক্সিম আদতে ক্যান্টেলোই। মার্কিন নাগরিকত্ব নিয়ে, পরিচয় গোপন করে লুকিয়ে রয়েছেন নিজের দেশে। 

কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কারণ, ব্রিটেনে আসার আগে যুক্তরাষ্ট্রে বড়ো কোনো যন্ত্র আবিষ্কার করেননি ম্যাক্সিম। সে-দেশে তাঁর নামে নেই কোনো পেটেন্টও। পাশাপাশি ব্রিটেনে আকস্মিকভাবেই উদ্ভব ঘটেছিল তাঁর। আসার সময় তাঁর বয়স ছিল ৪১ বছর। অন্যদিকে ক্যান্টেলো উধাও হয়েছিলেন ৪১ বছর বয়সেই। ক্যান্টেলোর অন্তর্ধান ও ম্যাক্সিমের উত্থানের মধ্যে অন্তর মাত্র ১ বছরের। তবে কি ক্যান্টেলো মধ্যবর্তী ১ বছর অদৃশ্য হয়ে বা অন্য কোনো দেশে চলে গিয়েছিলেন তাঁর টেলিপোর্টার যন্ত্রের মাধ্যমে? তারপর সেখান থেকে জাল পাসপোর্ট ও নথি বানিয়ে ফের ফিরে আসেন ব্রিটেনে? 

এধরনের হাজার প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল ১৮৯০-এর দশকের শেষদিকে। যদিও কোনোটিরও কোনো স্পষ্ট প্রমাণ মেলেনি। প্রমাণিত হয়নি ম্যাক্সিম সত্যিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন কিনা, আদৌ সে-দেশে তাঁর পরিবার-পরিজন-সম্পত্তি আছে কিনা। আর সেটা যদি থেকেই থাকে তবে কেন সমস্ত সম্পর্ক চ্ছেদ করে ব্রিটেনে এসে আস্তানা খুঁজলেন তিনি? 

ক্যান্টেলোর নিখোঁজ হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে প্রায় ১৪০ বছর। তবে আজও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে এই রহস্য। অন্যদিকে হিরাম ম্যাক্সিম হয়ে উঠেছিলেন বিশ শতকের শুরুর দিকে উদ্ভাবনীর জেরে হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটেনের অন্যতম ধনকুবের এবং নাইট। লক্ষ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছিল তাঁর তৈরি যুদ্ধাস্ত্র। পরবর্তীতে যা বদলে দিয়েছিল ইউরোপের যুদ্ধনীতি। বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল মেশিনগান। ফলে তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায়নি লন্ডনের পুলিশ। 

যদিও জীবনের শেষ কয়েকটি বছর সেভাবে প্রকাশ্যে আসেননি ম্যাক্সিম। ১৯১৬ সালের ২৪ নভেম্বর নিজের বাড়িতেই মারা যান মেশিন গানের আবিষ্কারক। দক্ষিণ লন্ডনে অবস্থিত একটি সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে। তবে মজার ব্যাপার হল, এই সমাধির স্মৃতিফলকে লেখা হয়েছিল কেবলমাত্র ম্যাক্সিমের নাম এবং মৃত্যু সাল। তাঁর জন্ম কিংবা মেশিন গান আবিষ্কারের কৃতিত্বের কথা লেখা হয়নি সেখানে। ম্যাক্সিম নিজেই নাকি বলে গিয়েছিলেন এভাবেই তাঁর সমাধিফলক লেখার জন্য। সেটা কি তিনি আদতে ক্যান্টেলো বলেই? জানা নেই উত্তর। সবমিলিয়ে আজও এই সমাধির সামনে দাঁড়ালে অমীমাংসিত এক রহস্যের গন্ধ পাবেন যে-কেউ। 

Powered by Froala Editor