৪০ হাজার ইহুদির প্রাণ বাঁচিয়ে হলোকাস্ট-হিরো জাপানের সুগিহারা

প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি ট্রেন। আর তাঁর জানলার কাছে থিক থিক করছে অসংখ্য মানুষের ভিড়। তাঁরা অধিকাংশই ইহুদি(Jews)। নাৎসি সেনাদের বন্দুকের নল এড়াতেই তাঁরা জড়ো হয়েছেন স্টেশনে। কিন্তু পালাতে গেলেও যে দরকার ভিসার। আর সেই ভিসা যিনি এনে দিতে পারেন, তাঁকেই যে বাধ্য হতে হচ্ছে শহর ছাড়তে। তবে নিরাশ করেননি তিনি। ট্রেন ছাড়ার আগে জানলা দিয়েই উড়িয়ে দিয়েছিলেন নিজের সই করা অজস্র ভিসার কাগজ। এমনকি নিজের স্ট্যাম্পটুকুও তুলে দিয়েছিলেন এক ইহুদি শরণার্থীর হাতে।

ইউরোপের ইতিহাসে অন্ধকারতম একটি অধ্যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হলোকাস্ট(Holocaust)। জাত্যাভিমানের নেশা যে কতটা হিংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে তা না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করাও অসম্ভব। কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও স্বয়ং দেবদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন অসংখ্য জার্মান নাগরিক। ‘জু-কিপার্স ওয়াইফ’-ই হোক বা ‘শিল্ডার্স লিস্ট’ কিংবা ’২০ সালে অস্কারজয়ী সিনেমা ‘জোজো র্যা বিট’— এমনই অসংখ্য বাস্তব গল্পকে তুলে এনেছে সিনেমার পর্দায়। তবে তাঁকে নিয়ে সেই মাত্রায় আলোচনা হয়নি কোনো, হয়নি চর্চাও। তবে নীরবেই হলোকাস্টে শরণার্থীদের ত্রাতা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। বাঁচিয়েছিলেন প্রায় হাজার চল্লিশেক ইহুদিকে।

চিউন সুগিহারা। জাপানি নাগরিক হলেও, এশিয়া ছেড়ে কূটনৈতিক হিসাবে জার্মানিতেই তাঁকে কাটাতে হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলো। আর চোখের সামনে থেকেই দেখেছিলেন হলোকাস্টের ভয়াবহতাকে। ১৯৩৯ সালে জার্মানি অধিকৃত লিথুয়ানিয়া ভাইস কনসাল হিসাবে যোগদান করেছিলেন সুগিহারা। জাপান, জার্মানি তখন সঙ্গবদ্ধভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে বিশ্বযুদ্ধের। বিপক্ষে তখনও পর্যন্ত সম্মুখ সমরে নামেনি রাশিয়া। বরং, হিটলারের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চলছে সোভিয়েত ডিকটেটর জোসেফ স্তালিনের। সুগিহারার দায়িত্ব ছিল রেড আর্মির গতিবিধির ওপরে নজর রাখা। রাশিয়ার সমস্ত কূটনৈতিক কার্যকলাপের সম্পর্কে রিপোর্ট দেওয়া বার্লিন এবং টোকিওতে। 

ততদিনে অবশ্য শুরু হয়ে গেছে ইহুদিদের ওপর চরমতম অত্যাচার। জার্মানি, পোল্যান্ড এবং লিথুয়ানিয়াজুড়ে তৈরি হয়েছে বিষাক্ত গ্যাসের অসংখ্য চেম্বার। ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে জীবন্ত মানুষকে। তাছাড়াও প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করে হত্যা করার ঘটনা তো আছেই। এসবের মধ্যেই নাৎসি বাহিনীর থেকে প্রাণ বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। লিথুনিয়ায় তখন হঠাৎই রটে যায় দেশ ছাড়ার জন্য যে ভিসা দরকার, তা দিতে পারবেন কনসাল। খবরটা একেবারে মিথ্যে নয়। তবে এতটাও সহজ নয় সেই সমীকরণ। ভিসা দিতে গেলে তাঁকেও অনুমতি নিতে হবে বার্লিন থেকে। 

আরও পড়ুন
কলকাতার মার্কিন সেনা, ‘নরখাদক’ কৃষ্ণাঙ্গ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলি

হ্যাঁ, শরণার্থীদের যন্ত্রণা দেখে নিজে থেকেই বার্লিনে যোগাযোগ করেছিলেন সুগিহারা। তবে স্পষ্টভাবেই তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়, কোনো ইহুদিকেই দেওয়া যাবে না ভিসা। আর তা দেওয়া হলে বিপদ বাড়বে স্বয়ং সুগিহারাই। তবে শেষ পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন পদাধিকারীর আদেশ অমান্য করেই ভিসা লেখা শুরু করেন সুগিহারা। গোপনে ভিসা কাগজে স্ট্যাম্প মেরে সই করে সেই কাগজ তুলে দিতেন শরণার্থীদের হাতে।

আরও পড়ুন
শত্রুপক্ষকে একা হাতে সামলে বিশ্বযুদ্ধের 'নায়ক' এই পর্তুগিজ সৈন্যই

আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেনানী ভালুক, ধরিয়ে দিয়েছিল গুপ্তচরকেও!

লিথুয়ানিয়ায় জাপানের দূতাবাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও এই লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন সুগিহারা। এককথায়, চুরি করেই ভিসার কাগজ এবং স্ট্যাম্প তিনি নিয়ে চলে এসেছিলেন বাড়িতে। দিন-রাত এক করেই শুরু করেছিলেন ভিসা লেখার কাজ। সঙ্গ দিতেন তাঁর স্ত্রী। পরবর্তীতে জানা যায় দিনে প্রায় ষোলো-সতেরো ঘণ্টা সময় শুধু ভিসার কাগজ লিখেছেন তিনি। তারপর ছাড়তে হয়েছিল লিথুয়ানিয়ার কওনাস শহর। সেই ফিরতি পথে দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েই শুরু হয়েছিল এই গল্পের। 

হিসেব বলে সব মিলিয়ে প্রায় ৬ হাজারেরও বেশি ভিসা স্বাক্ষর করেছিলেন সুগিহারা। এক একটি ভিসায় পালানোর সুযোগ পেয়েছিলেন এক-একটি আস্ত পরিবার। ফলে সব মিলিয়ে সংখ্যাটা দাঁড়ায় প্রায় ৪০ হাজারেরও বেশি। তার ওপরে এক শরণার্থীকে দিয়ে আসা ভিসার স্ট্যাম্প থেকেও মুক্তির পথ পেয়েছিলেন অজস্র শরণার্থী। 

বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পুনরায় জাপানে ফিরে এসেছিলেন সুগিহারা। তবে শেষ জীবনটা কেটেছে অর্থকষ্টেই। জার্মান, রাশিয়ান ভাষা জানার জন্য সামান্য টাইপরাইটিং কিংবা দোভাষীর কাজ মিললেও, পেট চলত না তাতে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাল্‌বও বিক্রিও করেছেন তিনি। ষাটের দশকের শেষের দিকে এক ইজরায়েলি দূত টোকিও-র রাস্তায় চিনতে পারেন তাঁর রক্ষাকর্তাকে। তিনিই প্রথম সামনে আনেন সুগিহারার গল্প। তা নাহলে হয়তো আজও প্রচারের আড়ালে অন্ধকারেই থেকে যেতেন তিনি। তবে তাঁকে নিয়ে আন্তর্জাতিক চর্চা না হলেও বছর দুয়েক আগে তাঁকে বিরল সম্মাননা জানায় জাপানের সরকার। তাঁর নামেই তৈরি হয় জাপানের পোর্ট অফ হিউম্যানিটি বন্দর। বিশ্বযুদ্ধে জাপানের নৃশংসতাও খুব কিছু কম ছিল জার্মানির থেকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ধরনের বিক্ষিপ্ত বিরুদ্ধতাই যেন প্রতীক হয়ে বেঁচে রয়েছে মানবিকতার…

Powered by Froala Editor