বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের নিয়েই প্যারালিম্পিকের পরিকল্পনা, আয়োজনে এক চিকিৎসক!

১৯৬০ সাল। রোম শহরে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক প্রতিযোগিতা। ঠিক সেই বছরই অলিম্পিক কেন্দ্রের অদূরে আয়োজিত হল আরেকটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। তবে এই প্রতিযোগিতা অলিম্পিকের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। আর তার সবচেয়ে বড়ো কারণ, প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া কোনো খেলোয়াড়ই শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ নন। প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো অঙ্গ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত। অধিকাংশই পূর্ববর্তী বিশ্বযুদ্ধে অঙ্গ হারিয়েছেন।

প্রতিবন্ধকতাযুক্ত খেলোয়াড়দের নিয়ে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়ে আসছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। সেখানেও শুরু থেকেই নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু একেবারে অলিম্পিক প্রতিযোগিতার অদূরে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন পছন্দ হল না অনেকেরই। অনেকেই ভাবলেন, এই আয়োজন আসলে অলিম্পিকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আবার কেউ কেউ অলিম্পিকের মঞ্চে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত খেলোয়াড়দের জায়গা করে দেওয়ার কথাও বললেন। এতেও গেল গেল রব তুললেন একদল। কেউ কেউ মনে করলেন, এভাবে আসলে খেলাধুলোর জন্য প্রয়োজনীয় শারীরিক দক্ষতার বিষয়টিই নস্যাৎ করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

এই বিতর্কের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছিল একটি আন্দোলন। এখন অবশ্য প্রত্যেক অলিম্পিক প্রতিযোগিতার সঙ্গেই অনুষ্ঠিত হয় প্যারালিম্পিক প্রতিযোগিতা। যার অর্থ দাঁড়ায় সমান্তরাল অলিম্পিক প্রতিযোগিতা। যদিও এই দুইয়ের মধ্যে এখন কোনো বিভেদ নেই। বরং হাতে হাত রেখেই চলে আয়োজন। আর কিছুদিনের মধ্যেই টোকিও শহরে শুরু হতে চলেছে অলিম্পিক গেমস। সেখানেও প্যারালিম্পিকের আয়োজনে সামিল হতে চলেছেন দেশবিদেশের বহু শারীরিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত খেলোয়াড়। কিন্তু এই আয়োজনের শুরুটা একেবারেই সহজ ছিল না। শক্ত হাতে সমস্ত বাধাবিপত্তির সঙ্গে লড়াই করে যিনি এই পরিসরটি তৈরি করে দিয়েছিলেন, তাঁর নাম ডাঃ লুডউইগ গাটম্যান।

১৮৯৯ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন জার্মানির টোস্ট শহরের একটু ইহুদি পরিবারে জন্ম গাটম্যানের। টোস্ট শহরেই প্রাথমিক পড়াশোনা করার পর ডাক্তার পড়তে যান ব্রেসলু শহরে। ১৯২৪ সালে স্নায়ুবিজ্ঞানে এমডি ডিগ্রি অর্জনের পর সেখানেই শুরু করেন গবেষণা। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত মোটামুটি নির্বিঘ্নেই চলছিল গবেষণা এবং চিকিৎসা। কিন্তু রাইখস্ট্যাহের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই ইহুদিদের উপর নিপীড়ন শুরু হয়। কোনো আর্য হাসপাতালে ইহুদি চিকিৎসক চিকিৎসা করতে পারবেন না, ডিক্রি জারি করে হিটলার সরকার। আর এর পরেই ব্রেসলু হাসপাতাল ছাড়তে হয় ডাঃ গাটম্যানকে। পরে ইহুদিদের জন্য পৃথক হাসপাতাল তৈরি করেছিলেন বেশ কয়েকজন চিকিৎসক। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ডাঃ গাটম্যানও। নাৎসি সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত হয়ে উঠছিল। পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠল, জার্মানি ছাড়তে হল গাটম্যানকে। আশ্রয় নিলেন ইংল্যান্ডে। দু-একটি শব্দের বেশি ইংরেজি জানেন না গাটম্যান। অথচ সেটুকু সম্বল করেই ইংল্যান্ড পাড়ি। এখানেই অক্সফোর্ড শহরে নতুন করে শুরু করলেন গবেষণার কাজ। আর সেখান থেকেই শুরু প্যারালিম্পিক আন্দোলনের।

১৯৪৩ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা অনেকটাই কমে এসেছে। কিন্তু ইংল্যান্ডজুড়ে তখন এক হাহাকার। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছেন অসংখ্য যুবক। কিন্তু প্রায় প্রত্যেকেই শারীরিক দক্ষতা হারিয়েছেন। অধিকাংশের আঘাত লেগেছে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে। ঠিক এই সময় সরকার সিদ্ধান্ত নিল, তাঁদের জন্য একটি পৃথক চিকিৎসাকেন্দ্র খোলা হবে। স্পাইনাল ইঞ্জিওরি বিষয়ক সেই চিকিৎসাকেন্দ্রের দায়িত্ব এসে পড়ল ডাঃ গাটম্যানের উপর। এদিকে তিনি ততদিনে গবেষণার মাধ্যমে একটি জিনিস প্রত্যক্ষ বুঝতে পেরেছেন। প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের সুস্থ করে তুলতে গেলে প্রয়োজন আত্মবিশ্বাসের বিকাশ। আর এই কাজে খেলাধুলো একটা বড়ো ভূমিকা নিতে পারে।

কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে হবে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা? ইউরোপে এমন ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। কিন্তু একজন ডাক্তারের এমন উদ্যোগে অবাক হয়েছিলেন অনেকেই। বহু ডাক্তার সরাসরি বিরোধিতাও জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনোকিছুতেই দমানো যায়নি গাটম্যানকে। ১৯৪৮ সালে প্রথম হুইলচেয়ার গেমের আয়োজন করলেন গাটম্যান। অংশগ্রহণ করলেন মাত্র দুটি দলের ১৬ জন প্রতিযোগী। কিন্তু দেখতে দেখতে বাড়তে লাগল এই খেলার জনপ্রিয়তা। পরের বছর শুরু হল পোলো, হকি, বাস্কেটবলের মতো খেলার আয়োজন। ১৯৫২ সালে প্রতিযোগিতায় যোগ দিল নেদারল্যান্ডের একটি দল। এই প্রথম ইংল্যান্ডের বাইরে থেকে এলেন প্রতিযোগীরা। ১৯৫৩ সালে ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইজিপ্ট, ইসরায়েল থেকে প্রতিযোগীরা যোগ দিলেন।

স্টোক ম্যান্ডাভিল শহরেই অনুষ্ঠিত হত এই প্রতিযোগিতা। তাই স্টোক ম্যান্ডাভিল গেম নামেই তার পরিচিতি গড়ে ওঠে। কিন্তু একের পর এক আন্তর্জাতিক দল অংশগ্রহণ করায় গাটম্যান ভাবলেন, ইংল্যান্ডের বাইরেও খেলার আয়োজন করা যাক। ১৯৬০ সালে রোমের অলিম্পিককে বেছে নিয়েছিলেন কেবন দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। কিন্তু সেই বছরই স্থির হয়, এবার থেকে প্রত্যেক অলিম্পিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হবে স্টোক ম্যান্ডাভিল গেমস। যে বছরগুলিতে অলিম্পিক হবে না, সেই বছরগুলিতে অনুষ্ঠান হবে স্টোক ম্যান্ডাভিল শহরেই। কিন্তু অলিম্পিকের বছরে অনুষ্ঠান হবে অলিম্পিকের দেশেই। যদিও সমস্ত দেশ খুব সহজে এই প্রস্তাব মেনে নেয়নি। ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিকের সঙ্গে অনুষ্ঠানের আয়োজন হলেও ১৯৬৮ সালে কানাডা অলিম্পিকের সময় আর্থিক অসুবিধার অজুহাতে বাদ দেওয়া হয় এই আয়োজন। সেইবছর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ইজরায়েল। এমনই নানা প্রতিবন্ধকতা ও বিতর্কের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ ১৯৮৮ সালে স্বীকৃতি পায় প্যারালিম্পিক গেমস। আজ তার জৌলুস অলিম্পিকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তবে এই সাফল্য দেখে যেতে পারেননি গাটম্যান। ১৯৮০ সালে প্রবল বিতর্কের মধ্যেই মৃত্যু হয় তাঁর।

ডাঃ গাটম্যানের উদ্দেশ্যে তৈরি গুগল ডুডল

 স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষক হিসাবে গাটম্যানের কৃতিত্ব আলাদা করে উল্লেখের দাবি রাখেই। কিন্তু তাঁকে মানুষ মনে রেখেছেন মূলত প্যারালিম্পিক আন্দোলনের স্থপতি হিসাবেই। সামাজিক কাজে অবদানের জন্য ১৯৬৬ সালে নাইট উপাধিও পান তিনি। আজ তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাতে বিশেষ ডুডল তৈরি করেছে গুগল। টোকিও প্যারালিম্পিক গেমসেও হয়তো নতুন করে মনে করা হবে তাঁকে। আর এই আয়োজন যে স্নায়ুচিকিৎসার ধারাও বদলে দিয়েছিল এক লহমায়, সে-কথা আলাদা করে বলাই বাহুল্য।

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More