বিলুপ্তপ্রায় ‘হাড়গিলা’ পাখি বাঁচাতে বিশেষ উদ্যোগ ১০ হাজার মহিলার

কয়েক ইঞ্চি লম্বা, মোটা চঞ্চু। ঝোলা গলকম্বল। ন্যাড়া মাথা। বলতে গেলে, একেবারেই সুশ্রী শব্দটা যায় না এই বর্ণনার সঙ্গে। তার ওপর শ্মশানে-ভাগাড়েই বিচরণ তাদের। গায়েও বেজায় দুর্গন্ধ। কাজেই সাধারণ মানুষ মোটেই পছন্দ করতেন না এই পাখিটিকে। এমনকি এই পাখি অশুভ ইঙ্গিত বয়ে আনে, এমনটাই বিশ্বাস তাঁদের।

লেপ্টোপিলোস ডুবিয়াস। শক্ত বিজ্ঞানসম্মত নাম শুনে ঘাবড়ে যাওয়ারই কথা। তবে এই পাখিটি আমাদের পরিচিত সারসেরই এক বিশেষ প্রজাতি। যা বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের মুখে যা পরিচিত ‘গ্রেটার অ্যাডজুট্যান্ট’ (Greater Adjutant) হিসাবে। তবে আসামের স্থানীয় মানুষ তাদেরকে চেনেন ‘হাড়গিলা’ (Hargila Bird) নামে। একটা সময় কীটপতঙ্গের মতোই কীটনাশক, বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলা হত এই প্রাণীটিকে। কখনও আবার ফাঁদ পেতে শিকার ধরা হত। তারপর পিটিয়ে মারা হত তাদের। এভাবেই বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল এই বিরল প্রজাতিটি। এবার এই প্রাণীটিকেই ফের বাস্তুতন্ত্রে ফিরিয়ে আনলেন আসামের মহিলারা।

কম্বোডিয়া এবং ভারত— কেবলমাত্র এই দুটি দেশেই দেখা যায় হাড়গিলা। তার মধ্যে আবার অসম এবং অরুণাচল— ভারতের মাত্র দুটি রাজ্যেই রয়েছে এই প্রাণীটির বাস। যার মধ্যে মূলত অসমই এই পাখিটির ব্রিডিং গ্রাউন্ড। আর সেখানে কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাসের জেরে বিলুপ্ত হয়ে বসেছিল বিরল এই সারস।

বছর কয়েক আগের কথা। গবেষণার জন্য সার্ভে করতে গিয়েই, ব্যাপারটা বিশেষভাবে নজর কাড়ে প্রাণীবিদ ডঃ পূর্ণিমা দেবী বর্মণের। পূর্ণিমা লক্ষ করেন, হাড়গিলাকে পাড়া ছাড়া করতে, কেটে ফেলা হচ্ছে গ্রামের একাধিক গাছ। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মানুষের সচেতনতা গড়ে না তুললে, একদিন চিরতরে ভারতের বুক থেকে হারিয়ে যাবে অ্যাডজুট্যান্ট সারস বা হাড়গিলা। সেই থেকেই শুরু হয় তাঁর লড়াই।

গ্রামের মহিলাদের নিয়েই শুরু হয়েছিল তাঁর এই কর্মযজ্ঞ। তাছাড়াও অসমের বিভিন্ন স্থানীয় ও আদিবাসী উৎসবগুলিকে তিনি বেছে নেন প্রচারের প্ল্যাটফর্ম হিসাবে। বোঝাতে শুরু করেন হাড়গিলার সৌজন্যে ভাগাড় থেকে প্রাণঘাতী রোগ ছড়িয়ে পড়ে না গ্রামে। বেঁচে থাকে বাস্তুতন্ত্র। কদম, সিরিশ-সহ যে-সমস্ত গাছে হাড়গিলার বাস, সেগুলি সংরক্ষণ ও রক্ষার জন্য চালু করেন ‘পক্ষী রক্ষাকর্তা’ এবং ‘অভিভাবক’ সম্মান। না, সরকারের পক্ষে থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সমর্থন পাননি তিনি তখনও। ব্যক্তিগত উদ্যোগেই এই সম্মাননা প্রদান করতেন তিনি। কিন্তু গাঁয়ের মানুষদের কাছে তা-ই বা কম কি?

ডঃ পূর্ণিমা বর্মণের এই উদ্যোগই বদলে দেয় অসমের পরিস্থিতি। গ্রামের মহিলাদের নিয়েই তৈরি হয় আস্ত একটি বাহিনি। ‘হাড়গিলা আর্মি’ নামেই পরিচিত যে দল। শুরুতে এই দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ১০-১৫ জন। আজ বাড়তে বাড়তে সেই সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছে ১০ হাজারে। বিলুপ্তপ্রায় সারসের সংরক্ষণ এবং তাদের প্রাণ রক্ষার দায়িত্ব বহন করে চলেছেন এইসকল আদিবাসী মহিলারাই।

পূর্ণিমার এই উদ্যোগের ইতিবাচক ফলাফলও বেশ স্পষ্ট সকলের সামনেই। ২০০৮ সালে যেখানে, মাত্র ২০০-র কাছে নেমে এসেছিল হাড়গিলার সংখ্যা, আজ সেখানে এই সারসের সংখ্যা ১০০০-এর বেশি। ২০২১ সালে তাঁর তত্ত্বাবধানেই পাচারিয়া গ্রামের একটি সরকারি স্কুলে তৈরি হয় হাড়গিলা লার্নিং অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টার। গ্রামের মানুষদের সচেতন করতে সেখানে আয়োজিত হয় একাধিক অনুষ্ঠান। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের গবেষকদের আনাগোনাও লেগে থাকে এই স্কুলে। সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম, অর্থাৎ ‘ইউএনইপি’-র ‘চ্যাম্পিয়নস অফ দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন অসমের প্রাণীবিদ। পেয়েছেন ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক মহিলা সম্মাননা— নারী শক্তি পুরস্কারও। তবে একা এই পুরস্কারের ভাগীদার তিনি, এমনটা মানতে নারাজ পূর্ণিমা। বরং, তাঁর কথায় এই পুরস্কার ১০ হাজার জনের ‘হাড়গিলা বাহিনী’-র সমস্ত সদস্যেরই…

Powered by Froala Editor