পিকে-চুনীর পর প্রয়াত বলরামও, নিভল ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগের শেষ প্রদীপ!

ইনসাইড-আউটসাড ডজ, দু’পায়ে ড্রিবল, চুলচেরা পাস, গোটা মাঠ জুড়ে গতিময় ছন্দ, চকিতে শট নেওয়ার ক্ষমতা— সবমিলিয়ে বলতে গেলে এক কমপ্লিট ফুটবলার। তুলসীদাস বলরাম। ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগের এক অন্যতম তারকা। পিকে-চুনী-বলরাম— এই ত্রয়ীর ওপর ভর দিয়েই দুবার অলিম্পিকে নজরকাড়া পারফর্মেন্স মেলে ধরেছিল ভারত। পিকে, চুনীর পর এবার অন্য দুনিয়ায় পাড়ি জমালেন এই ত্রয়ীর শেষ সদস্য বলরামও (Tulsidas Balaram)।

দীর্ঘদিন ধরেই শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন কিংবদন্তি ফুটবলার (Footballer)। হারাতে বসেছিলেন চোখের দৃষ্টিও। কয়েকদিন আগেই শারীরিক অবস্থার অবনতির জন্য কলকাতার এক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। সেখানেই আজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বলরাম। বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।

খেলেছেন বাংলার হয়ে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কিংবদন্তি ফুটবলারদের মধ্যেও অন্যতম তিনি। অথচ, জাতিগত দিক থেকে তিনি বাঙালি নন মোটেই। তুলসীদাসের উচ্চারণ শুনলেও, তা বোঝা শক্ত যে-কারোর পক্ষে। কিন্তু ভিনরাজ্যের বাসিন্দা হয়েও কীভাবে আদ্যন্ত বাঙালি হয়ে উঠলেন তিনি?

উত্তর পেতে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় ৮০ বছর। ১৯৩৬ সাল। সেকেন্দ্রাবাদের আমগুড়া গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম বলরামের। একবেলা ভাত জুটত কোনোমতে। তা নিয়েই চাষের জমিতে বল দাপিয়ে বেড়ানো। জেলা স্তরের ছোটো ছোটো ফুলবল টুর্নামেন্টে হাজির হওয়া নিয়মিত। তাতে দু-চার পয়সা জুটত কখনও। সঙ্গে টিফিন। তাই বা কম কী? তবে এই টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েই যে ভাগ্য বদলে যাবে তাঁর, তা কি তিনি নিজেও জানতেন?

পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিক সেটা। হায়দ্রাবাদে আয়োজিত এমনই একটি টুর্নামেন্টে হাজির হয়েছিলেন কিংবদন্তি ভারতীয় কোচ রহিম সাহেব। বলরামের ছন্দময় ফুটবল, পায়ের কাজ, গতি বিশেষভাবে নজর কেড়েছিল তাঁর। তিনিই উদ্যোগ নিয়ে, বলরামকে কেরলের সন্তোষ ট্রফি ক্যাম্পে সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। রাজি হয়ে যান কর্মকর্তারাও। তবে সমস্যা রয়ে যায় অন্য জায়গায়। সেকেন্দ্রাবাদ থেকে এর্নাকুলাম তো কম দূরত্ব নয়। এতটা পথ যেতে যে অর্থের প্রয়োজন। দু’বেলা ভাত জোটানোর সামর্থ্য নেই যার, তার কাছে শুধুমাত্র যাতায়াতের জন্য এত টাকা খরচ করা বাতুলতা।

ফের দেবদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন রহিম সাহেব। গাড়িভাড়া বাবদ নিজের পকেট থেকেই ১ টাকা ৪ আনা অনুদান দিয়েছিলেন বলরামকে। সেই সম্বলটুকু নিয়েই ভারতীয় ফুটবলে পদার্পন তার। প্রাথমিকভাবে কেরলে কিছুদিন খেলার পরই ভারতের জাতীয় দলে সামিল হন বলরাম। রহিম সাহেবের প্রশিক্ষণ এবং পিকে-চুনীর সংসর্গ যেন আরও ঘাতক করে তুলেছিল তাঁকে। পিকে-চুনী-বলরামের ত্রয়ী সে-সময় কাঁপ ধরাত বিশ্বের প্রথম সারির ফুটবলারদের বুকেও। এই ত্রয়ীর হাত ধরেই শুরু হয় ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগ।

১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিকে চতুর্থ স্থানাধিকার, ১৯৫৯-এর মারডেকা টুর্নামেন্টে রানার আপ, ১৯৬০-এর অলিম্পিকে গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে গেলেও শক্তিশালী ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ড্র বা ’৬২-র এশিয়ান গেমসে স্বর্ণজয়— পিকে-চুনীর সঙ্গে জোট বেঁধে একের পর এক কিংবদন্তি রচনা করেছেন তুলসীদাস বলরাম। 

১৯৫৬-র অলিম্পিকে নজর কাড়া পারফর্মেন্সের পর কলকাতার ক্লাব ইস্টবেঙ্গলে ডাক পান বলরাম। তাঁর নতুন ঠিকানা হয়ে ওঠে বাংলা। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ছাড়াও, বাংলার সন্তোষ ট্রফি দলেও জায়গা করে নেন বলরাম। ১৯৫৮ সালে, তাঁর গোলেই ১-০ ব্যবধানে সার্ভিসকে হারিয়ে ট্রফি ঘরে তোলে বাংলা। অন্যদিকে ইস্টবেঙ্গলকেও একাধিক ট্রফি এনে দিয়েছেন তিনি। ৬ বছরের ইস্টবেঙ্গল-কেরিয়ারে জিতেছেন ক্যালকাটা ফুটবল লিগ, ডুরান্ড কাপ, আইএফএ শিল্ড। ১৯৫৯-এর শিল্ড সেমিফাইনালে হ্যাটট্রিকও রয়েছে তাঁর। অবশ্য সে-বারের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েও চোটের কারণে ফাইনাল ম্যাচ খেলতে পারেননি তিনি। 

১৯৬২ সালে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে বিএনআর-এ স্বাক্ষর করেন বলরাম। জীবনের শেষ একবছর এই দলেই খেলেছেন তিনি। তারপর চোট ও অসুস্থতার কারণে তুলে রাখেন বুটজোড়া। তবে ফুটবল কেরিয়ার শেষ হলেও, সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি বাংলার সঙ্গে। বরং, আপন করে নিয়েছিলেন এই রাজ্যকেই। শেষ বয়সেও তাঁর মুখে প্রায়ই শোনা যেত, আত্মীয়রা দেশের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা বললেও, বাংলাতেই থাকতে চান তিনি। এ-রাজ্যেই ত্যাগ করতে চান শেষ নিঃশ্বাস।

হলও তেমনটাই। তবে অভিমানও কম ছিল না বলরামের। যে-ক্লাবের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন তিনি, সেই ক্লাবের প্রতিই খানিক অভিমানী ছিলেন বলরাম। ৯০-এর দশকে একটি বেনিফিট ম্যাচ নিয়েই এই বিতর্কের সূত্রপাত। ক্লাবের বক্তব্যে ব্যক্তিগতভাবে আহত হয়েছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, তাঁর মরদেহ যেন কোনোদিন ক্লাবে নিয়ে যাওয়া না হয়। ক্লাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হলেও, সচরাচর ক্লাবের মাটিতে পা দেননি তিনি।

পিকে-চুনী চলে যাওয়ার পর এই নিঃসঙ্গতা বেড়েছিল আরও। কমে এসেছিল তাঁর শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যাও। দীর্ঘ রোগভোগে হয়ে উঠেছিলেন জীর্ণ। এমনকি খেলার প্রতিও একধরনের অনীহা জন্ম নিয়েছিল তাঁর মধ্যে। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় খেলাধুলোর খোঁজখবর রাখা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন বলরাম। অবশেষে নিঃসঙ্গযাপন থেকে চিরদিনের মতো বিরতি নিলেন তিনি। আর তাঁর প্রয়াণেই নিভল ১৯৫৬-র ভারতীয় অলিম্পিক দল তথা ভারতীয় স্বর্ণযুগের অন্তিম প্রদীপ…

Powered by Froala Editor