একটানা ৩২ বছর ভূমিকম্প! শেষ অবধি আছড়ে পড়েছিল সুনামি হয়েই

ভূমিকম্প, শব্দটির সঙ্গে মানুষের পরিচয় নতুন নয়। একসময় পৃথিবী কেঁপে উঠতে দেখে মানুষ নানা অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কল্পনা করেছে। ধীরে ধীরে এসেছে বৈজ্ঞানিক ধারণাও। মাত্র কয়েক মিনিটের তাণ্ডব, কিন্তু তাতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল। তবে যদি বলা হয় এমন কোনো ভূমিকম্পের কথা, যা কয়েক মিনিটের নয়, বরং স্থায়ী হয়েছিল আরও দীর্ঘ সময়? হ্যাঁ, কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত চলতে থাকা ভূমিকম্পের কথাও আজকাল বিজ্ঞানীদের অজানা নয়। কম্পন মৃদু হলেও তা নিঃসন্দেহে ভূমিকম্প। এবং অদূর ভবিষ্যতে তার থেকে বড়ো ধরণের দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। কিন্তু এখানে এমন এক ভূমিকম্পের কথা বলছি, যার স্থায়িত্ব ছিল ৩২ বছর। হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগারই কথা। বিজ্ঞানীরাও অবাক হয়েছেন। কিন্তু সমস্ত তথ্যপ্রমাণের নিরিখে সন্দেহের অবকাশ নেই যে উনিশ শতকে ইন্দোনেশিয়ায় সত্যিই এমন এক ভূমিকম্প ঘটেছিল, যা একটানা ৩২ বছর স্থায়ী ছিল।

১৮৬১ সাল। এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ। রিখটার স্কেলে তার মাত্রা ছিল ৮.৫। সমুদ্রপৃষ্ঠের উপর আছড়ে পড়েছিল সিসমিক তরঙ্গের ঢেউ। ফলে দেখা দেয় সুনামি। কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল এই আকস্মিক দুর্ঘটনা। কিন্তু সত্যিই কি আকস্মিক ছিল এই ভূমিকম্প? সম্প্রতি নেচার জিওসায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে এমন প্রশ্নই তুলেছেন কয়েকজন ভূতাত্ত্বিক। বলা ভালো, তাঁরা তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন, এর উৎস নিহিত ছিল ১৮২৯ সালের একটি ঘটনায়। সমুদ্রের তলদেশের ওঠানামা তখন মানুষের নজরে আসেনি। কিন্তু তার ছাআপ ছড়িয়ে ছিল প্রবাল উপত্যকায়। আর সেই ছাপ পরীক্ষা করেই ১৮৬১ সালের ভূমিকম্পের উৎস খুঁজে পান সিঙ্গাপুরের নন্যাং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির গবেষক ঋষভ মল্লিক ও তাঁর সহযোগীরা।

এই প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা যাক। ২০০৫ সালের যে সুনামি ইন্দোনেশিয়া থেকে জাপান এমনকি বাংলার বুকেও আছড়ে পড়েছিল, রিখটার স্কেলে সেবার কম্পন ছিল ৫-এর কিছু বেশি। তবে এই ভূমিকম্পও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০১৫ সালে নন্যাং ইউনিভার্সিটির গবেষকরাই তার প্রমাণ দিয়েছিলেন। জিপিএস প্রেরিত তথ্য থেকে দেখা যায় মৃদু ভূমিকম্প চলছিল বিগত ২ সপ্তাহ ধরেই। ধীরে ধীরে জমা হওয়া সেই শক্তিই হঠাৎ বড়ো চেহারা নেয়। ঠিক এমনই ঘটনা ঘটেছিল ১৮৬১ সালেও। প্রমাণ আছে প্রবালের স্তরে। কোন সময় কোন অংশে সমুদ্রের জলস্তর কতটা উঁচু ছিল, তা বুঝতে প্রবাল স্তরের কাঠামো বিশ্লেষণ করে থাকেন বিজ্ঞানীরা। রিষভ মল্লিক এবং তাঁর সহকর্মীরা দেখিয়েছেন, সুমাত্রা দ্বীপ সংলগ্ন অঞ্চলে ১৮২৯ সাল থেকেই জলস্তর হঠাৎ দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। এর কারণ কী? হিমবাহের গলনের ফলে নয়। কারণ জলস্তরের এই বৃদ্ধি প্রায় বছরে ১০ মিলিমিটার হারে চলতে থাকে। অতএব তাঁদের অনুমান, সমুদ্রের তলদেশ ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছিল। আর এইধরণের অবনমনের সময়েই টেকটনিক প্লেটগুলির মধ্যে একধরণের চাপ সৃষ্টি হয়। যার ফলে মৃদু ও দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকম্প চলতে থাকে।

এই ধরণের দীর্ঘস্থায়ী কম্পন রিখটার স্কেলে ধরা পড়ে না। তার অস্তিত্ব বোঝা যায় টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়া দেখে। ফলে ১৯৯০-এর দশকের আগে বিজ্ঞানীদের কাছে এমন ঘটনা ছিল একেবারেই অপরিচিত। এর মধ্যেই অবশ্য বেশ কিছু মৃদু তরঙ্গের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। কখনও প্রশান্ত মহাসাগরের কানাডা উপকূল অঞ্চলে, কখনও ভারত মহাসাগরের অস্ট্রেলিয়া সংলগ্ন অঞ্চলে। অনেক সময়েই এইসব মৃদু কম্পন থেকে বড়ো ভূমিকম্পও ঘটতে দেখা গিয়েছে। আবার কখনও এক জায়গা থেকে তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে অন্যত্র। সারা পৃথিবীজুড়ে ক্রমশ চলতে থাকা এই ধরণের তরঙ্গগুলিই আসলে টেকটনিক প্লেটের স্থানান্তর ঘটায় বলে মনে করছেন রিষভ মল্লিক। তবে আরও কত ধরণের প্রভাব রাখতে পারে এমন কম্পন, সেই রহস্য পুরোপুরি জানা নেই।

আরও পড়ুন
১৫০০ বছর আগেও ভারতে প্রচলিত ছিল ভূমিকম্প-প্রতিরোধক নির্মাণকৌশল, তাজ্জব প্রত্নতাত্ত্বিকরা

তথ্যসূত্রঃ An earthquake lasted 32 years, and scientists want to know how, Maya Wei-Haas, National Geographic

আরও পড়ুন
আটলান্টিকের তলায় বিরল ‘বুমেরাং’ ভূমিকম্প, চার বছর পর শনাক্ত করলেন বিজ্ঞানীরা

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
১৫৮৫-র বন্যা থেকে ১৮৯৭-এর ভূমিকম্প – দুর্যোগ কাটিয়ে বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে সুন্দরবন

More From Author See More