দুই খণ্ডে বিভক্ত চার্চ, মাঝখান দিয়ে চলে গেছে রাস্তা

পৃথিবীর সবথেকে বিখ্যাত চার্চগুলির কথা উঠলে সবার আগে কোনটির কথা মনে পড়বে? কেউ বলবেন ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার বাসিলিকার কথা। কারোর মনে পড়তে পারে ফ্রান্সের নট্রে-দাম চার্চের নাম। জেরুজালেমের হোলি সেপালচার চার্চ কিংবা স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া ক্যাথিড্রামের নামই-বা বাদ যায় কীভাবে? সেই তুলনায় হয়তো একেবারেই অপরিচিত ঠেকতে পারে অস্ট্রিয়ার গমুন্ড (Gmund) প্রদেশের একটি চার্চের কথা। স্থানীয় ভাষায় যার নাম ‘গেটেইল্টে কিরচে আম ক্রেউজিবিচল’। সহজ ইংরেজিতে যাকে বলা যেতে পারে ‘ডিভাইডেড চার্চ’ (Divided Church) বা ‘দ্বিখণ্ডিত চার্চ’। আর এই চার্চের সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বয়ং মাইকেল এঞ্জেলোর নাম।

কিন্তু এরকম অদ্ভুত নাম কেন এই চার্চের? কারণ আক্ষরিক অর্থেই দুই ভাগে বিভক্ত চার্চটি। যার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। পথযাত্রীরা তো বটেই, দিব্যি চারচাকা গাড়িও চলে যেতে পারে এই রাস্তা দিয়ে। পৃথিবীতে এরকম আর কোনো চার্চের অস্তিত্ব আছে কিনা সন্দেহ? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এই অদ্ভুত নির্মাণ কেন? তার জন্য পিছিয়ে যেতে হবে ২৭৫ বছর। তখনও অস্তিত্ব ছিল এই রাস্তাটির। ঐতিহাসিক কারণে প্রায় সমগ্র ইউরোপই জানত এই রাস্তার কথা। কারণ এই পথ দিয়েই সহজে যাতায়াত করা যেত জার্মানির সালজবার্গ থেকে ইতালির ভেনিসে। ‘সহজে’ শব্দটি ব্যবহার করা হল দূরত্বের কথা ভেবে। নতুবা পাহাড়ি রাস্তায় পথচলার বিপদ কম ছিল না। ব্যবসার পাশাপাশি পূর্ব ইউরোপের তীর্থযাত্রীরা এই পথ দিয়েই পৌঁছোতেন ইতালির চার্চগুলিতে।

আর সেখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত গমুন্ড। বলা যেতে পারে দীর্ঘপথের মাঝে এক টুকরো বিশ্রামকেন্দ্র। একটা ছোটো চার্চ অবশ্য আগে থেকেই ছিল এখানে। যাকে বলা হত ‘ক্রশ অফ দ্য হিলস’। তীর্থযাত্রীরা অত্যন্ত পবিত্র মনে করত চার্চটিকে। যেন পথের মাঝে স্বয়ং ঈশ্বর বসে আছেন তাদের পথ দেখানোর জন্য। তাদের সুবিধার কথা ভেবে ১৭৪৮ সালে সংস্কার করা হয় চার্চটিকে। রাস্তা থেকে দুই মিটার উঁচুতে চারদিকে লোহার রেলিং দিয়ে সুসজ্জিত করা হয় চার্চটি। কিন্তু যে তীর্থযাত্রীদের জন্য এত আয়োজন, মুশকিলে পড়ল তারাই। সে অর্থে পথচারীরা কেউই কোনোদিন চার্চের ভিতরে ঢুকতেন না। বাইরে থেকেই প্রার্থনা জানিয়ে চলে যেতেন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। নতুন নির্মাণে সেই সুযোগ আর রইল না। বিশেষ করে প্রবল সমস্যায় পড়তে হল ঝড়-বৃষ্টির দিনে।

তাহলে তো রাস্তার উপরেই গড়ে তোলা যায় রাস্তার বাকি অংশ। সেই প্রস্তাবও উঠেছিল। এবার বাধ সাধলেন স্থানীয় লোকেরা। যুগের পর যুগ ধরে এই রাস্তা তাদের কাছে ‘ঈশ্বরের কাছে’ পৌঁছোনোর ঠিকানা। অত্যন্ত পবিত্র মনে করে তারা। ফলে কোনোভাবেই এই রাস্তা বন্ধ করা যাবে না। অবশেষে পথের বিপরীত দিকে গড়ে উঠল আরেকটি চার্চ। দেখে মনে হবে, কেউ যেন মাঝখান থেকে বিভক্ত করে দিয়েছে চার্চটিকে। নতুন নাম হয় ‘ডিভাইডেড চার্চ’।

আরও পড়ুন
বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত চার্চ, আশ্চর্য সমাপতনই প্রাণ বাঁচাল শিল্পীদের

তীর্থযাত্রার দিন আর নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে গেছে এই পথ ধরে। রাস্তাটি এখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি। শুধু অতীতের ঐতিহ্য নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে গমুন্ডের দুটি চার্চ। যার একটিতে রয়েছে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ মূর্তি। প্রার্থনাসঙ্গীত গাওয়া হয় এখানে বসেই। আর উলটো দিকের চার্চে বর্তমানে শুধুই বসার জায়গা। আরেকটি বিশেষ কারণে ইতিহাসের পাতায় রয়েছে এই চার্চের নাম। ‘ফ্রেস্কো’ অর্থাৎ চার্চের দেওয়াল চিত্রটি অলংকরণ করা হয়েছিল মাইকেল এঞ্জেলোর ছবির আদলে। না, নিজে হাতে এ-কাজ করেননি তিনি। তা সম্ভবও ছিল না। তবে একটি ‘ফ্রেস্কো’ তিনি এঁকে দিয়েছিলেন বন্ধু অরসিয়েল ডেল্টা ভলটেরা-কে। পরবর্তীতে সেটিই আঁকা হয়েছিল গমুন্ডের চার্চের দেওয়ালে। ঘটনাচক্রে ১৮৬১ সালে সংস্কারের সময় প্রায় নষ্ট করে ফেলা হয়নি। পরে অবশ্য চেষ্টা করা হয়েছে সেটিকে সঠিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার। 

আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধে লুঠ করেছিল নাৎসি বাহিনী, ৭৭ বছর পর পোল্যান্ডে ফিরছে ৪০০ কেজির চার্চ-বেল

ঠিক তার পরের বছর অস্ট্রিয়া থেকে বহু দূরে কলকাতায় তৈরি হয় একটি গির্জা। যাকে আজকের দিনে সকলে চেনে ‘জোড়া গির্জা’ নামে। পুরনো চার্চ ভেঙে যাওয়ার পর মল্লিকবাজার অঞ্চলে গড়ে তোলা হয় নতুন গির্জা। যার মাথায় রয়েছে দুটি চূড়া। আপাতদৃষ্টিতে কোনো সংযোগ হয়তো নেই। তবু ‘জোড়া’-র বিপরীতেই যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে গমুন্ডের ‘দ্বিখণ্ডিত চার্চ’। 

Powered by Froala Editor