মৃত্যুর বিভীষিকায় মোড়া অস্তিত্বহীন এক জাহাজ, আজও অমীমাংসিত ‘ওরাং মেদান’-এর রহস্য

গত শতকের চারের দশকের ঘটনা। যুদ্ধের আবহে নজরদারি চলছে প্রায় প্রতিটি দেশের আন্তর্জাতিক কাজকর্মের উপর। একই সঙ্গে এদেশ থেকে ওদেশে জাহাজপথে গোপনে পাচার হয়ে যেত গুপ্ততথ্য। চলত চোরাকারবারি। সেই সময়ে সিলভার স্টারের নামের আমেরিকার বাণিজ্যিক জাহাজের কাছে এল একটি এস. ও. এস। মালয়েশিয়ার মালাকা (Malacca) খালের কোনো একটি অঞ্চল থেকে আসছে বিপদবার্তা। মর্স কোডে পাঠানো সেই বার্তার শেষ দুটি শব্দ ছিল ‘আই ডাই’। 

পুরো বক্তব্যটি যথেষ্ট রোমহর্ষক। প্রেরক জাহাজটির রেডিও অপারেটর যেন ধারাভাষ্য দিচ্ছেন এক ভয়ানক মৃত্যুযজ্ঞের। জাহাজের সকলেই মৃত। ডকে, ক্যাপ্টেনের কেবিনে, চার্টরুম সর্বত্র ছড়িয়ে আছে মৃতদেহ। সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে শেষ জীবিত প্রতিনিধি সাহায্য চাইছেন সিলভার স্টারের কাছে। জাহাজের নাম এস. এস ওরাং মেদান (S. S. Ourang Medan)।

অবস্থান নির্ণয় করে সিলভার স্টারের একটি উদ্ধারকারী দল পৌঁছে গেল সেখানে। কিন্তু যে দৃশ্য তারা দেখল, তাতে নিশ্চয়ই ভরা কুয়াশার মধ্যেও তাদের শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে গেছিল। কারোর শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু প্রতিটি মৃতদেহের মুখেই রয়েছে বিভীষিকার ছাপ। জাহাজের প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে মৃতদেহ। এমনকি একটি ছোটো টেরিয়ার কুকুর পর্যন্ত বাঁচতে পারেনি সেই অদ্ভুত মৃত্যু থেকে। কোনো জলদস্যুর আক্রমণ? মনে তো হয় না। তবে? প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে চেষ্টা করা হল ওরাং মেদানকে ফিরিয়ে আনার। ততক্ষণে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছে সিলভার স্টার। কিন্তু ব্যর্থ হল সব চেষ্টা। আচমকাই প্রবল বিস্ফোরণে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় ওরাং মেদান। কোনো দেহাবশেষের চিহ্ন পর্যন্ত রইল না।

এই খবর স্থলভাগে পৌঁছোতেই তৈরি হল অসংখ্য তত্ত্ব। কিন্তু সেগুলিকে যাচাই করার কোনো উপায়ই নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল ওরাং মেদান বলে কোনো জাহাজের অস্তিত্বই নেই কোনো দেশের কাছে। রহস্য ঘনীভূত হল আরো। পরে মালাকার সামুদ্রিক এলাকায় তল্লাশি চালানো হলেও ধ্বংসাবশেষের কোনো চিহ্ন মেলেনি। বিস্ফোরণ হলেও কি এভাবে উবে যেতে পারে একটা গোটা জাহাজ? তবে কি সবটাই কোনো ‘ভৌতিক’ কাণ্ড? অনেকে অবশ্য মনে করেছিলেন, জাহাজটি সম্ভবত সুমাত্রার। কারণ সেদেশের ভাষায় ‘ওরাং’ শব্দের অর্থ মানুষ। আর মেদান সেখানকার এক দ্বীপের নাম। ব্যস, এটুকুই। গুজব আর মনগড়া তত্ত্ব ছাড়া প্রামাণ্য কোনোকিছুই পাওয়া গেল না, যা দিয়ে এই রহস্যের সমাধান হয়। 

আরও পড়ুন
যেন দ্বিতীয় টাইটানিক! হিমশৈলের ধাক্কায় ডুবে যাওয়া পৃথিবীর শেষ জাহাজ ‘হান্স হেডটফট’

এর মধ্যে খোঁজ মিলল জেরি র‍্যাবিট বলে একজনের। যিনি দাবি করতে লাগলেন যে, তিনি ওই জাহাজেরই ক্রু-সদস্য ছিলেন। একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হল তাঁর সম্পূর্ণ বয়ান। চিনের সাংহাই থেকে ওরাং মেদান যাচ্ছিল কোস্টা রিকার উদ্দেশ্যে। ঠিক কী নিয়ে যাচ্ছিল, বলতে পারলেন না তিনি। এতটাই গোপনীয়তা ছিল সেই জাহাজে, যে তাঁর ধারণা কোনো নিষিদ্ধ পদার্থ পাচারের দায়িত্ব ছিল ওরাং মেদানের। হয়তো সেই কারণেই কোনো দেশের তালিকায় নেই জাহাজের নাম। ঘটনার দিন তিনি আচমকাই এক সহকর্মীকে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখেন। প্রথমে পেটে ও বুকে ব্যথা। তারপর শুরু হয় খিঁচুনি। অস্বস্তি হচ্ছিল তাঁর নিজেরও। ক্রমে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন একের পর এক কর্মী। অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে অসুস্থ শরীরে তিনি আরো পাঁচজনকে নিয়ে ভেসে পড়েন লাইফবোটে। অবশেষে দিন দশেক পরে এক দ্বীপে এসে ঠেকে তাঁদের লাইফবোট। কিন্তু ততদিনে মৃত্যু ঘটেছে বাকি পাঁচজনের।

আরও পড়ুন
নদীর দু-ধার ঘেঁষে জাহাজের ‘সমাধিক্ষেত্র’

র‍্যাবিটের বয়ান কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সেই নিয়ে ছিল নানা মত। এঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ব্যক্তি ছিলেন জার্মানির থিয়োডর সিয়ের্সডর্ফার। দীর্ঘদিন তিনি গবেষণা চালান ওরাং মেদান নিয়ে। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বই ‘দ্য ডেথ শিপ ইন সাউথ শিপ’। সেখানে তিনি দাবি করেন, জাহাজে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম সায়নাইড ও নাইট্রোগ্লিসারিন মজুত করা ছিল। তাদের মধ্যে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়াই সম্ভবত দায়ী বিস্ফোরণের জন্য। না, এবারও সমস্ত রহস্যের সমাধান হল না। ইংল্যান্ডের একটি পত্রিকার মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীনই ঘটেছিল এই ঘটনা। তাদের কাছে নিশ্চিত খবর ছিল এই বিষয়ে। অথচ আমেরিকায় সেই সংবাদ প্রকাশিত হয় যুদ্ধ শেষের পরে। র‍্যাবিট ছাড়া আর কেউ জাহাজের গোপনীয়তার কারণ চিহ্নিত করেনি। কোনো পরিবার এগিয়ে আসেনি মৃতদেহের সন্ধানে। তাহলে? অসংখ্য প্রশ্ন ঘিরে রয়েছে ওরাং মেদানের দুর্ঘটনা ঘিরে। যাদের উত্তর মেলেনি আজও। 

Powered by Froala Editor