জঙ্গলের মধ্যে অদ্ভুতদর্শন গির্জা, উদ্দেশ্য কী?

সেদিন রাতে আচমকাই ঘুম ভেঙে গেল ড্যানিয়েল আলামসজাহের। এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। যেন ঈশ্বর স্বয়ং তাঁকে এসে বলছেন একটি চার্চ নির্মাণের কথা। তিনি নিজে খ্রিস্টান, কিন্তু দৈবশর্ত অনুযায়ী তৈরি করতে হবে এমন এক চার্চ, যেখানে প্রার্থনা করতে আসতে পারবে সকল ধর্মের মানুষ। কিন্তু এত লোক থাকতে তাঁকেই কেন বেছে নেওয়া হল এই কাজের জন্য? পরদিন থেকে আবার সাধারণ জীবনযাত্রায় ফিরে গেলেও, মাথা থেকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না স্বপ্নের কথা। 

এভাবে কেটে গেল প্রায় একটি বছর। স্বপ্ন দেখার সময় তিনি ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার (Indonesia) জাকার্তাতে। ১৯৯০ সাল নাগাদ ছুটি কাটাতে গেলেন স্ত্রীর দেশের বাড়ি মাগলাং-এ। জাভা থেকে বেশি দূরে নয় জায়গাটি। এর আগেও বহুবার এসেছেন এখানে, প্রতিবার মুগ্ধ হয়েছেন অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভায়। এবারও ব্যতিক্রম হল না। আপন মনেই ঘুরে বেড়াতে লাগলেন পাহাড়ি অঞ্চলে। কিন্তু একটি ছোটো পাহাড়ের চুড়োয় এসে খটকা লাগে তাঁর। কোথায় যেন দেখেছেন এই জায়গাটি? মনে পড়ে যায় এক বছর আগের স্বপ্নদৃশ্যের কথা। ঠিক এইখানেই চার্চ নির্মাণের ‘আদেশ’ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে! 

স্থানীয় প্রশাসনের থেকে মাত্র কয়েক হাজার টাকায় কিনে নেন জায়গাটি। তারপর শুরু হয় চার্চের কাজ। যেহেতু সকলেরই অধিকার থাকবে এখানে, তাই প্রচলিত চার্চের মতো বানাতে চাননি এটিকে। এমনকি নাস্তিকরাও আসতে পারবে এই চার্চে। নিজেই তৈরি করলেন নকশা। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্যত্র। স্থানীয় মানুষ ও কর্মীদের সকলেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। বহুমতের কথা বলে তাদেরকে স্বপক্ষে আনার কাজটি সহজ নয়। পাহাড়ের জঙ্গল কেটে অন্য ধর্মের মানুষের উপাসনাগৃহ বানানো একপ্রকার আগ্রাসন রূপেই দেখতে থাকে তারা। আর এই সময়েই আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েন ড্যানিয়েল। দুয়ের টানাপোড়েনে বছরের পর বছর বন্ধ হয়ে থাকে চার্চের কাজ।

অবশেষে ২০০০ সালে পূরণ হয় তাঁর স্বপ্ন। এবার এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয় নিজের হাতে তৈরি নকশা নিয়েই। স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, চার্চটির আদল হবে আশ্চর্য এক পাখির চেহারার মতো। তার রূপ সম্পূর্ণ মনে ছিল না ড্যানিয়েলের। তাঁর কল্পনায় সেটি হয়ে যায় পায়রা। সেভাবেই নির্মিত হচ্ছিল চার্চটি। কিন্তু কাজ শেষের পরে দেখা গেল ‘শান্তির প্রতীক’ পায়রা নয়, সেটি দেখতে হয়ে গেছে মুরগির মতো। মূল দরজার উপরের অংশের মাথায় বিরাট ঝুঁটি আর পিছন দিকে ছড়িয়ে আছে পালক। মাঝখানের কাঠামোটি টাইটানিকের মতো লম্বা। সব মিলিয়ে এক কিম্ভূত রূপ। চার্চটির নাম রাখা হল ‘গেরেজা আয়াম’ (Gereja Ayam), স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ মুরগির গির্জা (Chicken Church)। এতে অবশ্য লাভই হল ড্যানিয়েলের। আশ্চর্য এই চার্চ দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে এল পর্যটকরা। তুঙ্গে উঠল জনপ্রিয়তা।

আরও পড়ুন
যিশুর ফেরার অপেক্ষায় এখনো দিন গোনে যে গির্জা

এবার এক দারুণ চাল দিলেন ড্যানিয়েল। যে চার্চের মূল উদ্দেশ্য ছিল সর্বধর্ম সমন্বয়, সেখানে প্রবেশের জন্য রাখলেন টিকিটের ব্যবস্থা। ভারতীয় মুদ্রায় এখন তার মূল্য একশো টাকার উপরে। শোধ হয়ে গেল সমস্ত ধারদেনা, পুরো স্থাপত্যটিকে ঢেলে সাজালেন নতুন করে। মুরগির মাথায় তৈরি হল একটি ক্যাফে। আয়ের রাস্তা খুলে গেল সেখান থেকেও। অবশ্য চার্চের অর্থ থেকেই সেবা করা হয় দুঃস্থদের। তবু প্রশ্ন তো থেকেই যায়, স্বপ্নে কি সত্যিই সব ধর্মের জন্য চার্চ তৈরির নির্দেশ পেয়েছিলেন ড্যানিয়েল, নাকি পুরোটাই তাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধির খেলা? 

আরও পড়ুন
যিশু নন, এই গির্জায় পূজিত হন স্বয়ং মারাদোনা

Powered by Froala Editor