যিশুর ফেরার অপেক্ষায় এখনো দিন গোনে যে গির্জা

‘নেতাজি ফিরবেন’— আশাবাদী এই পোস্টার এখনও মাঝেমধ্যেই দেখা যায় কলকাতার রাস্তা-ঘাটে। গত পাঁচশো বছরে চৈতন্যও যে কতবার বিভিন্ন রূপে ‘জন্ম’ নিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কেউ যদি বলে যিশু ফিরবেন বা শীঘ্রই আসছেন তিনি? চমকে ওঠার কথা বৈকি। যিশুকে নিয়েও যে এরকম আশা লালিত-পালিত হয়, তাও এই বাংলার বুকেই, এ এক আশ্চর্য ঘটনা বটে।

তারিখটা ছিল ২২ অক্টোবর, ১৮৪৪। আমেরিকার একদল মানুষ উইলিয়াম মিলারের নেতৃত্বে অপেক্ষা করছিলেন যিশুর পুনরাগমনের। বাইবেল-টাইবেল ঘেঁটে তাঁরা দাবি করেছিলেন, ওইদিনই আবার মর্ত্যে আবির্ভূত হবেন যিশু; যত পবিত্র ভক্ত ও সন্তান আছে তাঁর, দেখা দেবেন। বলাই বাহুল্য, মিলারের সেই দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু এই আশা এবং ঘোষণা-অপেক্ষাকে কেন্দ্র করেই জন্ম নিল এক নতুন সম্প্রদায়— অ্যাডভেন্টিস্ট (Adventists)। 

এই প্রসঙ্গে পরে ফিরব। আপাতত গ্রাম বাংলার এক ছোট্ট গির্জার কথা উল্লেখ করা যাক। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই হাজির হওয়া মাঠের এক কোণে অবস্থিত এই গির্জায়। বাইরের কারুকার্যে বিশেষ চমক নেই। ছিমছাম আর-পাঁচটা বাড়ির মতোই তার চেহারা। মাথার ওপর ক্রস চিহ্ন দেখে আন্দাজ করা যায় পরিচয়। নামটি অদ্ভুত। আর সেই নামের আড়ালেই যে লুকিয়ে আছে আশ্চর্য এক গল্প, তা কে জানত? 

চন্দ্রকোণা সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্ট চার্চ 

 

আরও পড়ুন
যিশু নন, বড়োদিনে জন্মেছিলেন সূর্যদেব— এমনটাই বিশ্বাস ছিল প্রাচীন রোমানদের

চন্দ্রকোণার ইতিহাসের খোঁজে, চন্দ্রকোণার অলিতে গলিতে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়েছিল ‘চন্দ্রকোণা সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্ট চার্চ’-টি (Chandrakona Seventh Day Adventist Church)। বড়োদিনের সকাল অথচ লোক সমাগম নেই! অন্যান্য গির্জায় এই দিনে দেখি মানুষের ভিড়, উৎসবের পরিবেশ, সাজানো ক্রিসমাস ট্রি, যিশুর উপাসনাকক্ষে ফুল-মালা ইত্যাদি। অথচ, এই গির্জায় এসে দেখা গেল, সেসবের বালাই নেই। গির্জা বলতে অবশ্য আমরা যেটা সহজে বুঝি, তা নয়। নিচে একতলায় বসতবাড়ি। আর সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলে একটা বিশাল হলঘর। সেই হলঘরেরই একপ্রান্তে উপাসনার স্থান। ডানদিকে টেবিল। বাঁদিকে পোডিয়াম। আর একেবারে মাঝখানে একটি ক্রুসের মতো অবয়ব। ব্যস। যিশুর মূর্তি তো দূরের কথা, খ্রিস্টধর্মের আলাদা কোনো স্পষ্ট চিহ্নও নেই। এরকম ছিমছাম গির্জা এর আগে দেখিনি। খোঁজ নিতে গিয়ে আলাপ হল নিতাইচন্দ্র বিশ্বাসের সঙ্গে। এই গির্জার তত্ত্বাবধায়ক তিনিই। অবশ্য নামের আগে রেভারেন্ট বা ফাদার ব্যবহার করেন না তিনি। তাঁর উপাধি হল ‘পাস্টার’। অর্থাৎ, পাস্টার নিতাই চন্দ্র বিশ্বাস। বিগত সাত বছর ধরে রয়েছেন চন্দ্রকোণার এই গির্জায়। একতলায় তিনি ও তাঁর পরিবারের বসবাস এবং দোতলায় এই উপাসনাগৃহ। 

আরও পড়ুন
বছরের প্রতিটা দিনই বড়োদিন পালন করেন ইংল্যান্ডের ‘মিস্টার ক্রিসমাস’!

তবে রহস্য লুকিয়ে রয়েছে নামেই। ‘সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্ট চার্চ’। কী ব্যাপার? নিতাইবাবুই জানালেন উইলিয়াম মিলারের কথা। আরও বললেন, ধীরে ধীরে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের মধ্যেই একটা শাখা যুক্তরাষ্ট্রে বলীয়ান হয়ে উঠছিল, যারা বিশ্বাস করত যে ‘অ্যাডভান্ট’ হবে। অ্যাডভান্ট অর্থাৎ যিশুর পুনরাগমন। এই মতে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদেরই বলা হয় অ্যাডভেন্টিস্ট। ঘোষণা হল, অপেক্ষাও হল। যিশু আর এলেন না। বিশ্বাসীদের অনেকে কেটেও গেলেন। কিন্তু যাঁরা থেকে গেলেন তখনও, তাঁদের মধ্যেই তৈরি হল চারটি উপসম্প্রদায়। সেই উপসম্প্রদায়দেরই একটি হচ্ছে ‘সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্ট’।

আরও পড়ুন
নতুন বই পড়েই কাটে ক্রিসমাস, আইসল্যান্ডের বইপ্রেমীদের বৃহত্তম উৎসব বড়োদিনেই

গির্জার উপাসনাকক্ষ

 

সেভেন্থ ডে কেন? এর পিছনেও লুকিয়ে আরেক গল্প। বাইবেলে বর্ণিত আছে, পবিত্র বিশ্রামের দিন হল শনিবার। অথচ, ক্যাথলিকরা এই বিশ্রামের দিনটিকে রবিবার বলেই ধরে নেয়। ইতিহাস বলে ৩২১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন এই বদলটি ঘটিয়েছিলেন। অ্যাডভেন্টিস্টরা কঠোরভাবে বাইবেলের অনুসারী, ফলে তাঁরা পবিত্র দিন অর্থাৎ ‘সাবাথ’-টিকে শনিবার বলেই গণ্য করেন। আর ক্রমে ক্রমে এটিই হয়ে উঠল তাঁদের মূল পরিচয়চিহ্ন। প্রত্যেক সপ্তাহে শনিবার দিনটিকে পবিত্র দিন হিসাবে গণ্য করে তাঁরা বিশেষ উপাসনা করেন ও মনে মনে বিশ্বাস পোষণ করেন যিশু একদিন ফিরবেন। অর্থাৎ, যিশুর ফেরার অপেক্ষায় দিন কাটানো এবং শনিবার দিনটিকে সপ্তাহের সপ্তম দিন বা ‘সাবাথ’ হিসাবে ধরে নেয় যে ধর্মগোষ্ঠী, তারাই সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্ট। 

খ্রিস্টধর্মের ভেতরেও যে এত গল্প লুকিয়ে, জানা ছিল না। এদের কিন্তু সংখ্যালঘু ভাবলেও চলবে না। সারাবিশ্বে ২১ মিলিয়নেরও বেশি অনুগামী আছে এদের। এমনকি বিভিন্ন দেশে শাখাও রয়েছে। বাকি ভারতের কথা বাদ দিলাম, আমাদের পশ্চিমবঙ্গেই কলকাতা, হুগলি, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, নদিয়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর-সহ একাধিক জেলায় রয়েছে তাদের শাখা। ভারতের প্রথম গির্জাটি তৈরি কলকাতাতেই। ১৯০৮ সালে। পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণার গির্জাটিও সেই শাখারই একটি বিভাগ। কবে তৈরি হয়েছিল চন্দ্রকোণার এই গির্জা?

পাস্টার নিতাই চন্দ্র বিশ্বাস

 

খুব আগেকার কথা নয় অবশ্য। দুই দশক আগে। অর্থাৎ, ২০০২ সালে। প্রথম পাস্টার ছিলেন বসন্ত দাস। নিতাইবাবু চতুর্থ পাস্টার হিসাবে এখানে যোগদান করেন। তাঁর জন্ম মছলন্দপুরে। খ্রিস্টধর্মের প্রথাগত শিক্ষা নিয়েছেন, বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন, তারপর সব ছেড়ে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন মিশনারির কাজে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হল, কখনও খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিতই হননি তিনি। আমার প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, অ্যাডভেন্টিস্টদের এমন কোনো বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই। যিশুর ওপর বিশ্বাস রেখে, যিশুর ভজনা করলেই হয়। তার জন্য আলাদা করে ব্যাপ্টিজমের প্রয়োজন পড়ে না। এদিকে নিতাইবাবুর স্ত্রী জলি বিশ্বাস প্রথম জীবনে ছিলেন ক্যাথলিক। পরবর্তীকালে অ্যাডভেন্টিস্টদের মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রহণ করেন এই ধর্মমত। 

কেন একজন ব্যক্তি অ্যাডভেন্টিজমের প্রতি আকর্ষিত হবেন? নিতাইবাবুর কাছে হাজির এর উত্তরও। তিনি বললেন, ‘যিশু তো কখনও বাঁধা-ধরা কোনো নিয়ম বলে দেননি। যিশু বলেছিলেন, আমি যেভাবে জীবনযাপন করেছি, তোমরাও সেভাবেই করো।’ খ্রিস্টধর্মের অন্যান্য শাখায় যেমন ধর্মীয় গোঁড়ামি দেখা যায়, অ্যাডভেন্টিস্টরা সেসব থেকে অনেকটাই মুক্ত। যে-কারণে এই গির্জাতেও কোনো যিশুর মূর্তি নেই। বাইবেলের প্রথম আজ্ঞায় যিশু বলেছিলেন, “আমার সাক্ষাতে তোমাদের অন্য কোনো মূর্তির দরকার নেই।” এই কথাকেই ধ্রুব বলে ধরেন অ্যাডভেন্টিস্টরা। শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল আমাদের, ‘সর্বং খলিদ্বং ব্রহ্ম’— এই আপ্তবাক্যটির কথাও। ব্রহ্ম সর্বত্রই বিরাজিত। এইখানে এসেই সনাতন ব্রহ্ম-ব্যাখ্যা ও অ্যাডভেন্টিস্টদের যিশু একাকার হয়ে যান। 

গির্জার শীর্ষদেশ 

 

বড়োদিন, অথচ আলাদা করে কোনো নজরকাড়া উৎসব নেই। বিষয় হল, অ্যাডভেন্টিস্টরা বিশ্বাস করেন না যে, ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিন। আদতে কোথাও-ই এর কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই। ফলে সেই নিশ্চিত প্রমাণ না-থাকাটাকেই ধ্রুব বলে ধরে নিয়ে অ্যাডভেন্টিস্টরা গড়ে তুলেছেন এই পথ। তাঁরা নিরামিষাশী, নিষ্ঠাবান জীবনযাপন করেন এবং যিশুর পথে মতি রেখে চলেন। জিজ্ঞেস করলাম, চন্দ্রকোণার মতো এই প্রাচীন মন্দিরনগরীতে খ্রিস্টানদের সংখ্যা কত? রহস্যময় হাসলেন পাস্টার নিতাই চন্দ্র বিশ্বাস। বললেন, “এখানে চন্দ্রকোণাতে কিছু প্রাচীন খ্রিস্টান পরিবার আছে বটে, তাঁরা আগে হয়তো ক্যাথলিক ছিলেন, পরবর্তীকালে আমাদের মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অ্যাডভেন্টিস্ট গির্জায় যাতায়াত করেন। এছাড়া অনেক আদিবাসী পরিবারও কিন্তু এই গির্জার সদস্য। তাঁরা সাবাথে আসেন, অংশগ্রহণ করেন, প্রার্থনাও। গির্জার সংস্পর্শে তাঁদের জীবনযাত্রাতেও বদল হয়েছে বৈকি। এমন পাঁচ-ছটি আদিবাসী পরিবারও আছে, যারা রীতিমতো অ্যাডভেন্টিস্ট ধর্মে দীক্ষিত। একঘরে করে দেওয়ার হুমকিতেও পিছপা হননি তাঁরা। এঁরাই তো আমাদের স্বপ্ন। এঁরাই তো আদর্শ। প্রভু যিশুর নিশান তো বহন করে চলেছেন এঁরাই।” 

নিতাইবাবু থামলেন। কতকটা আমাদের অনুরোধেই শুরু হল গান। হলঘরে তখন গমগম করছে দুই কিশোরীর কণ্ঠ। শেষ হওয়ার পর জানতে পারলাম, এক কিশোরী নিতাইবাবুর মেয়ে হলেও, আরেকজন কাছেরই এক আদিবাসী গ্রামের মেয়ে। আদিবাসী মেয়েটির ইংরাজি উচ্চারণ শুনে আমরা স্তম্ভিত। অবশ্য বাংলার ঔপনিবেশিক ইতিহাসে এমন ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। মিশনারিরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আদিবাসীদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেছেন, তাঁদের জীবনযাত্রায় উন্নতি এনেছেন— এ আর নতুন কথা কী! কিন্তু এই একবিংশ শতকে তৈরি একটি গির্জা, বলপ্রয়োগ তো দূরের কথা— যেখানে দীক্ষিত হওয়ার কড়াকড়ি নেই, যেখানে শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও মতাদর্শকে ভালোবেসে আদিবাসীরা যাতায়াত করছেন, দীক্ষিত হচ্ছেন, এমনকি তাঁদের নবীন প্রজন্ম ইংরাজি গানেও এত সাবলীল— তা দেখলে থমকে হতে হয়। 

যিশু আদৌ ফিরবেন কিনা, আমরা জানি না। নিতাইবাবুরাও কি জানেন? উনিশ শতকে তৈরি একটা নির্দিষ্ট বিশ্বাসকে আঁকড়ে বেঁচে রয়েছেন তাঁরা। সারা বিশ্বে রয়েছেন তাঁদের মতো আরও অসংখ্য মানুষ। তাঁদেরই উপাসনাগৃহের সাক্ষী দিচ্ছে এই গির্জা। তবে যিশু ফিরুন বা না-ফিরুন খ্রিস্টধর্মের এই বিচিত্র শাখাটি আমাদের যে এঁদের প্রতি ফিরে তাকাতে বাধ্য করবে, তা নিশ্চিত। 

‘Jesus is coming soon—’। বেশ তো, যদি আসেনই, মোলাকাত না-হয় হয়েই যাবে একবার…

Powered by Froala Editor

Latest News See More