যিশু নন, এই গির্জায় পূজিত হন স্বয়ং মারাদোনা

ছোট্ট গির্জা ঝলমল করছে মোমবাতির আলোয়। ভেতরে শতাধিক মানুষের ভিড়। হাঁটুমুড়ে বসে তাঁরা প্রার্থনা করছেন। কণ্ঠ মেলাচ্ছেন ‘ঈশ্বর’-এর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পাদ্রির মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে—

“আওয়ার দিয়েগো
হু আর্ট অন আর্থ
হালোড বি দাই লেফট ফুট
দাই ম্যাজিক কাম,
দাই গোলস বে রেমেমবারড।
আমেন…”

খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনার সঙ্গে পরিচয় থাকলে, এমন প্রার্থনা শুনে চমকে ওঠাই স্বাভাবিক। তবে ফুটবলের সাম্রাজ্য আর্জেন্টিনায় হাজির হলে দর্শন মিলবে এমনই এক আশ্চর্য দৃশ্যের। আর্জেন্টিনার রোজারিও শহর। দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনার জন্মভূমি। সেখানেই রয়েছে এই আশ্চর্য গির্জা— ইগলেসিয়া মারাদোনিয়ানা। ইংরাজিতে অনুবাদ করলে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘চার্চ অফ মারাদোনা’। হ্যাঁ, যিশু নয়, বরং মারাদোনাই (Maradona) এই গির্জার পূজিত ঈশ্বর। স্থানীয় ভাষায় দিওস। গির্জার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই চোখে পড়বে D10S লেখা নীল-সাদা পতাকাও। 

এই গির্জার ইতিহাসও বেশ বৈচিত্রময়। ১৯৯৭ সাল। ৩৭ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবল থেকে বিদায় নিয়েছিলেন মারাদোনা। ঠিক তার পরের বছরই এই গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর মাতৃভূমি রোজারিও-তে। নেপথ্যে আর্জেন্টাইন তারকার তিন ভক্ত— হেক্টর ক্যাম্পোমার, হার্নান হামেজ এবং আলেজান্দ্রো ভেরন। তবে তাঁদের দিয়েগো-আরাধনা চলে আসছে আরও আগে থেকেই। মারাদোনা খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর সমমনস্ক ফুটবল সমর্থকদের এক ছাতার তলায় আনতেই এই গির্জা প্রতিষ্ঠা করেন এই তিন বন্ধু। প্রাথমিকভাবে মারাদোনার ছবির সামনেই চলত আরাধনা। পরবর্তীতে ১৯৮৬-এর ঐতিহাসিক ‘হ্যান্ড অফ গড’-এর আদলে তৈরি করা হয় মারাদোনার মূর্তি। তাছাড়াও গির্জায় জায়গা পেয়েছে মারাদোনার একাধিক স্মারক।

অন্যান্য গির্জার মতোই ইগলেসিয়া মারাদোনিয়ানাতেও রয়েছে দীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা। সাধারণ গির্জায় যেভাবে ব্যাপ্টিজম করা হয়, ঠিক সেভাবেই দীক্ষা দেন দিয়েগো-পাদ্রিরা। প্রথম শর্ত ‘মারাদোনিয়ানা’ ধর্মে দীক্ষিত হতে গেলে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে হবে আর্জেন্টিনা এবং মারাদোনাকে। প্রাণ দিয়ে আজীবন রক্ষা করতে হবে নীল-সাদা জার্সি। জীবনের সবচেয়ে পবিত্র জিনিস হিসাবে সম্মান দিতে হবে ফুটবলকে। তাছাড়া মারাদোনিয়ান গির্জার নীতি ও নিয়মাবলি নিজ-নিজ পরিসরে প্রচার করার দায়িত্ব নিতে হবে ধর্মাবলম্বীদের। এবং শেষ শর্ত হল, নিজের মধ্যম নাম এবং পুত্র সন্তানের প্রথম নাম রাখতে হবে দিয়েগো। 

জন্মলগ্নে এই গির্জার সদস্যসংখ্যা ছিল ৩০-৫০ জন। সে-সময় পাদ্রির কাজ করতেন তিন প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীতে সংখ্যাটা বাড়তে বাড়তে গিয়ে ঠেকে ২ লক্ষে। শুধু আর্জেন্টিনাই নয়, বর্তমানে বিশ্বের ১৩০টি দেশের মানুষ এই গির্জার সদস্য। তবে মারাদোনিয়ানা ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন আর্জেন্টাইন এবং ইতালিয়ানরা। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে ন্যাপোলি শহরের বাসিন্দারা। 

রোজারিও-র এই গির্জায় প্রতিদিনই প্রার্থনা জানিয়ে যান কোনো-না-কোনো ভক্ত। কেউ আবার রেখে যান ফুলের তোড়া, জ্বালিয়ে যান মোমবাতি। তবে বছরের দুটি দিন মানুষের ভিড়ে উপচে ওঠে ইগলাসিয়া মারাদোনিয়ানা। প্রথমটি ৩০ অক্টোবর। ১৯৬০ সালে এই দিনেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন মারাদোনা। তাই রোজারিও-র গির্জায় এই দিনটিই পালিত হয় বড়োদিন হিসাবে। দ্বিতীয়টি হল ২২ জুন। ১৯৮৬-এর বিশ্বকাপে এই দিনই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুটি ঐতিহাসিক গোল করেন মারাদোনা। এই ঘটনাকে স্মরণ করেই এদিন পালিত হয় ইস্টার। মারাদোনার মৃত্যুর পরও বদলায়নি গির্জার এই ‘ক্যালেন্ডার’। 

অবশ্য রোজারিও-র এই গির্জাই নয়, মারাদোনার মৃত্যুর পর বিশ্বের অন্যত্রও শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে ইগলাসিয়া মারাদোনিয়ানা। গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মেক্সিকোতেও। সবমিলিয়ে এই গির্জার হাত ধরেই এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের মধ্যে দাগ কেটে চলেছেন ফুটবলের রাজপুত্র…

Powered by Froala Editor