বিশ্বজোড়া নিন্দা উপেক্ষা করেই ফের ডলফিন নিধন জাপানে

একের পর এক ডুবুরি ডাইভ দিয়ে নেমে যাচ্ছেন সমুদ্রের জলে। সঙ্গে রয়েছে কোনো না কোনো ধারালো অস্ত্র। বছরের এই কয়েকদিন তাঁদের একটাই লক্ষ্যা, ডলফিন (Dolphin)। সম্প্রতি জাপানের (Japan) তাইজি উপকূলে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল চিরাচরিত ডলফিন শিকার উৎসব (Dolphin Hunt Festival)। আর তাই নিয়ে প্রতিবছরের মতো এবারও সমালোচনায় সরব পরিবেশকর্মীরা। বিগত এক দশক ধরে বারবার সরকারের কাছে এই উৎসব বন্ধের আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু এর সঙ্গে যে জাপানের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি এবং লোকজীবন জড়িয়ে আছে।

ডলফিন বর্তমানে অন্যতম বিপন্ন সামুদ্রিক প্রাণী হিসাবে চিহ্নিত। স্বাভাবিকভাবেই তার সংরক্ষণের কথা উঠছে পৃথিবীজুড়ে। কিন্তু জাপানের মানুষের আবেগ এখানে এক ভিন্ন যুক্তির সামনে দাঁড় করায়। তাঁরা পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দেন, এখনও পৃথিবীর মোট ডলফিনের প্রায় ২০ শতাংশ রয়েছে জাপানের পার্শ্ববর্তী প্রশান্ত মহাসাগরে। সেইসঙ্গে ডলফিনের মাংস জাপানের দীর্ঘদিনের প্রচলিত এবং জনপ্রিয় খাদ্যউৎস। তাইজি শহরের মেয়রের কথায়, পৃথিবীতে খাদ্যের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রাণীহত্যা হয় আমেরিকায়। অথচ সেখানকার মানুষই অন্য দেশের মানুষের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপাতে এগিয়ে আসেন। জাপান একাধিক দ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠা দেশ। সেখানে স্থলভাগের পরিমাণ যেমন কম, তেমনই কম ডাঙার প্রাণী বিশেষ করে গবাদিপশুর সংখ্যাও। আর তাই খাদ্যের জন্য জাপানিরা নির্ভর করে থাকেন সামুদ্রিক প্রাণীদের উপরেই। তিমি এবং ডলফিন তাই অন্যতম জনপ্রিয় খাদ্য।

১৯৬০ সাল নাগাদ তাইজি উপকূলে অন্তত ৫০০ মৎসজীবি কাজ করতেন। তখন এই এলাকার মোট করের অধিকাংশটাই আসত মাছ চাষ থেকে। আর তাই মৎসজীবিদের বার্ষিক অনুষ্ঠানগুলিকেও বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই দেখত সরকার। এখন মৎসজীবির সংখ্যা কমেছে। কিন্তু উৎসবগুলো থেকে গিয়েছে। আর এর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো উৎসব এই ডলফিন শিকার উৎসব। অন্তত ৫০০ বছর ধরে চলছে এই উৎসব। এমনকি বর্তমানে যাঁরা মাছ চাষের জীবিকা ছেড়ে দিয়েছেন, তাঁরাও পরিবারের ঐতিহ্য বজায় রাখতে এই কয়েকদিনের মধ্যে একবার অন্তত সমুদ্রে নামেন। সমুদ্র থেকে ডলফিনদের ধরে ডাঙায় নিয়ে আসার পরেই মেরে ফেলা ছিল প্রাচীন প্রথা। তবে এখন জাপান এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অ্যাকোয়েরিয়ামে ডলফিনের চাহিদা প্রচুর। তাই কিছু সংখ্যক ডলফিনকে বাঁচিয়ে রাখা হয় রপ্তানির জন্য। আর বাকিদের গতি হয় রান্নাঘরে।

এই উৎসবের সময় অন্তত ৩০ রকমের প্রথাগত রান্না হয় জাপানি পরিবারগুলিতে। আর প্রতিটা রান্নারই মূল উপকরণ ডলফিনের মাংস। ডলফিন শিকার উৎসব বন্ধ করলে যে তাই দেশের বহু মানুষের ভাবাবেগে আঘাত লাগবে, সে-কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সারা পৃথিবীর মতো যে জাপানেও ডলফিনের সংখ্যা কমছে, তা স্পষ্ট। আর তাই এবারের উৎসবে নিয়ন্ত্রণ আনার পরামর্শ দিয়েছিল জাপান সরকার। তাইজি কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছিল, ডলফিন হত্যার সংখ্যা যেন ১৮০০-র মধ্যে থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। যদিও সেই নির্দেশ মানা হয়নি বলেই অভিযোগ অনেকের। অন্তত আড়াই হাজার ডলফিন হত্যা করা হয়েছে ১০ দিনের উৎসবে। আর এই উৎসবের বাইরেও ডলফফিন শিকার চলতেই থাকে, এমনটাই মত স্থানীয় পরিবেশ সংগঠনগুলিরও। বেশ কিছু পরিসংখ্যানের মতে, জাপানে বছরে অন্তত ২০ হাজার ডলফিন হত্যা করা হয়। একদিকে সামুদ্রিক পরিবেশে দূষণ, আর অন্যদিকে এই নিধনযজ্ঞ – এই দুয়ের জাঁতাকলে পড়ে ডলফিনের অবস্থা সত্যিই সঙ্গিন।

আরও পড়ুন
ড্রোনের ব্যবহার এবার ডলফিন সংরক্ষণেও, দৃষ্টান্ত তৈরি নিউজিল্যান্ডের

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
তিমি এবং ডলফিনের মৃত্যুতে ঘাতক শব্দদূষণই, চাঞ্চল্যকর তথ্য জার্মান গবেষকের

More From Author See More