প্রশাসন উদাসীন, মৃতপ্রায় খালের প্রাণ ফেরাচ্ছেন সুন্দরবনের বাসিন্দারাই

যতদূর দেখা যায় ছোট্ট খাল ঢেকে গেছে সবুজ পানায়। আর সেই জল-কাদাতে নেমেই পানা তুলে আনছেন একদল ছেলে-মেয়ে। কারোর বয়স পনেরোও-ষোলো বছর। কারোর আরেকটু বেশি। সকলেই শিক্ষার্থী। সঙ্গে একইভাবে কাজ করে চলেছেন বয়োজ্যেষ্ঠ কিছু মানুষও। সম্প্রতি এমনই ছবিই ধরা পড়ল সুন্দরবনের রায়দিঘি থাকার কাশীনগর অঞ্চলে। আর উপায় বা কী? এলাকার একমাত্র নিকাশি মাধ্যম তথা প্রাচীনতম নদী মণিগঙ্গা খাল আক্রান্ত ভয়াবহ দূষণে। তাই এমন অভিনব উদ্যোগ নিলেন আঞ্চলিক সংগঠন ‘শতমুখী পরিবেশ কল্যাণ কেন্দ্র’-এর শিক্ষার্থী ও সদস্যরা।

“দীর্ঘদিন ধরেই পঞ্চায়েত, থানা, বিডিও, রায়দিঘি ইরিগেশন অফিস এবং বাজার কমিটি— প্রত্যেকটা জায়গাতেই আমরা সংস্কারের আর্জি জানিয়ে আসছি। কিন্তু তারপরেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কারো পক্ষ থেকেই। সে-কারণেই আমাদের এই উদ্যোগ। কিন্তু এ তো মহাসমুদ্র। আমরা ভাবলাম অন্তত শুরুটা করি। আমাদের ছোটো পদক্ষেপ দেখে অন্তত যদি প্রশাসন এগিয়ে আসে। আমরা সেই মডেলটা দেখালাম”, বলছিলেন শতমুখী পরিবেশ কল্যাণ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বীজেন্দ্র বৈদ্য।

তবে শুধু নদী সংস্কারেই থেমে নেই তাঁদের উদ্যোগ। মজে যাওয়া নদী থেকে তুলে ফেলা কচুরি পানা দিয়েই জৈব সার তৈরি করছেন ছাত্রছাত্রীরা। বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এসে তাঁদের দেওয়া হয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণও। বীজেন্দ্রবাবু জানালেন, “কচুরি পানা নিয়ে বাইরে বিভিন্ন কাজ হচ্ছে। বাংলাদেশেও হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখানে এই দিকটা নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনাই করা হয় না। যে কচুরিপানাটা সরানো হচ্ছে সেটাকেই আমরা বাইপ্রোডাক্ট হিসাবে ব্যবহার করছি। আর এই সার স্বল্পমূল্যে স্থানীয় কৃষকদের হাতেই তুলে দেওয়া হবে। তবে প্লাস্টিকজাত যে বর্জ্যগুলো নদীতে রয়েছে, সেগুলো সরানোর সাধ্য আমাদের নেই। তার জন্য জেসিবি বা বড়ো যন্ত্র দরকার।”

আরও পড়ুন
ময়মনসিংহে নদীর গতিপথ আটকে অবৈধ নির্মাণ, আশঙ্কায় স্থানীয়রা

তবে আজ থেকে নয়, সাড়ে তিন দশক আগে থেকে শুরু হয়েছিল ‘শতমুখী পরিবেশ কল্যাণ কেন্দ্র’-এর পথ চলা। পরিবেশরক্ষাই ছিল মূল লক্ষ্য। পাশাপাশি সংস্কৃতির চর্চা, শিক্ষাদান, নাচ-গান-চিত্রকলা প্রশিক্ষণ-সহ সচেতনতামূলক একাধিক কর্মসূচি নিয়ে চলেছে সংস্থাটি। প্রতিবছর বর্ষা এলেই শুরু হয় বৃক্ষরোপণ। তবে মূলত তাল এবং খেঁজুরের বীজরোপণেই বেশি করে জোর দেয় এই সংস্থা। কারণ? বীজেন্দ্রবাবুর কথায়, “এই ধরণের গাছের সংখ্যা অত্যন্ত কমে যাচ্ছে সুন্দরবনে। অথচ তাল বা খেঁজুরই ঘূর্ণিঝড়কে আটকে পারে সবথেকে বেশি। তাই সার দিয়ে আমরা এই ধরণের গাছ লাগাই।”

আরও পড়ুন
আদিগঙ্গার সংস্কারের জন্য বেঁধে দেওয়া হল ৩০ মাসের সময়সীমা

সম্প্রতি তরুণ প্রজন্মকে অঞ্চলের ঐতিহ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করতেও একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলিতে চলেছে কর্মশালাও। তার তত্ত্বাবধানে ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত অধ্যাপকরা। ইতিহাসকে, অতীতের শিকড়কে এড়িয়ে যে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় কোনো সভ্যতারই। ‘শতমুখী’ নামের মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে তার ছাপ। যা সুন্দরবনেরই হারিয়ে যাওয়া নাম। সব মিলিয়ে সুন্দরবনকে এক নতুন দিনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে এই সংস্থা। 

আরও পড়ুন
সংস্কারের অভাবে ধ্বংস হতে বসেছে হেরিটেজ সাইট

তবে এই বছরটার আরও একটা বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বীজেন্দ্রবাবু মনে করিয়ে দিলেন, আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে আরও এক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থেকেছিল রায়দিঘি। পরিবেশরক্ষা এবং উন্নয়নের দাবিতে পায়ে হেঁটেই দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন অঞ্চলের তিন যুবক। ইন্দিরা গান্ধীর কাছে হাজির হয়েছিলেন দাবিসনদ নিয়ে। প্রাথমিকভাবে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা গিয়েছিল সেবার। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নিজে এসে পরিদর্শন করে গিয়েছিলেন সুন্দরবনের অবস্থা। সই করেছিলেন একাধিক প্রকল্পে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্থানীয় কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণেই আর সার্বিকভাবে রূপায়িত বাস্তবায়িত হয়নি সেসব প্রকল্প।

সময় গড়িয়েছে। প্রশাসন বদলেছে। শুধু বদল আসেনি সুন্দরবনের অবস্থার। বরং, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দূষণের মাত্রা। পূর্বসুরিদের কথা স্মরণ করেই তাই আবার নতুন করে যুদ্ধে নেমেছেন পরিবেশযোদ্ধারা। তাঁদের এই লড়াইতে বর্তমান প্রশাসনের টনক নড়ে কিনা, এখন সেটাই দেখার…

Powered by Froala Editor

More From Author See More