একসময় ঘুরে-ঘুরে মাছও বিক্রি করেছেন বইপাড়ার ‘মুশকিল আসান’ সুধন্যদা

কলেজস্ট্রিটে যাদের নিত্য যাতায়াত, পড়ার নেশায় ব্যাগভর্তি বই নিয়ে ঘরে ফেরার অভ্যাস যাঁরা ছাড়তে পারেন না কিছুতেই, একডাকে সুধন্যদাকে চেনেন তাঁরা। সূর্য সেন স্ট্রিটের মোড়ে ধ্যানবিন্দু আর সুধন্যদা একে অপরের পরিপূরক। ছোট্ট একটা বইয়ের দোকান, অথচ দোকানের সামনে একবার দাঁড়িয়ে পড়লে মনে হবে যেন ছোটখাটো একটা লাইব্রেরিতে এসে গেছেন। ভেতরে অসংখ্য আলো, উজ্জ্বল সব তারাদের ভিড়।

অথচ এই ধ্যানবিন্দু শুরুর সময়ে সুধন্যদা দোটানায় ছিলেন। সুধন্য সরকার নামে পরিচিত হলেও, তাঁর আসল নাম সুব্রত। কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর দেওয়া নাম সুধন্য। সারাজীবনের এই আশীর্বাদ ক’জন পায়!

আরও পড়ুন
গত শতকের এই বিখ্যাত বাংলা প্রকাশনা সংস্থাটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কেন?

সুধন্য সরকার যৌবনে এ এইচ হুইলারে চাকরি করতেন। তখন বয়স কম, টিনটিন, অ্যাসটেরিক্স পড়তে যেতেন দোকানে। পুঁথিগত বিদ্যায় ভরসা ছিল না কোনোদিনই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে উচ্চমাধ্যমিকের পর থমকে গেছিল প্রথাগত শিক্ষা। তখন সংসারে মা, বউ, মেয়ে। বন্ধুর কথামতো তিনি এ এইচ হুইলারে যোগ দিলেন। তখন টেন্ডারের দায়িত্বে তিনকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। দোকানে ভালো পত্রিকা, বাংলা বই আসত। রমরমিয়ে চলছে দোকান। মাঝে মধ্যে টেন্ডার বা চার্জম্যান বদল হত দোকানের।

বন্দ্যোপাধ্যায়দের পর দোকানের দায়িত্বে এসেছিলেন জৈনরা, আর তারপর বিহারের রায়বাবুরা। ভাঙন শুরু এখানেই। রায়বাবুরা হিন্দি বই রাখতে জোর করলেন। ব্যবসা পড়তির দিকে চলল। হিন্দি বইয়ের কারণে ক্রমশ কমতে লাগল ক্রেতা। কাঁহাতক নিজের পকেট থেকে রোজকার বরাদ্দ টাকা জমা দেওয়া যায়। বাধ্য হয়ে সাইকেলে করে মাছ বিক্রি শুরু করলেন সুধন্যদা। শুধু তাই নয়, এরপর ইমিটেশনের গয়না বেচা শুরু হল। এহেন সময়ে অভীক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ধ্যানবিন্দু খোলার প্রস্তাব দেন।

সুধন্যদার সঙ্গে অভীকবাবু কাজ করতে চাইলে তিনি ধন্দে পড়েন। আবার যদি লোকসান হয় তাহলে কী করবেন? জালান কলেজের উল্টোদিকে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হলের কাছে একটি গাছের পাশে ছোট্ট একটি জায়গা। তবু শুরু হল। শুরু হল বিভিন্ন প্রকাশনীর কাছ থেকে বই নিয়ে রাখাও। লিটল ম্যাগাজিনের আখর এই দোকান। প্রথম ক্রেতা সৌম্য চক্রবর্তী। কেনেন অফবিট প্রকাশনীর ‘মৃত্যুব্যাধি’ বইটি।

আজ সৌম্য চক্রবর্তী আর নেই। বলতে বলতে গলা ধরে আসে সুধন্যদার। নেই রবিশংকর বলও। তিনিও আসতেন বই কিনতে। এককোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সুধন্য এই বইটা দাও, ওটা দাও। ফরমায়েস অনুযায়ী বই বের হত। শুরু হল পুরনো, নতুন, জীবিত পাঠকের আনাগোনা। যারা চলে গেছেন, তাঁরাও আছেন অলক্ষ্যে। হাসিমুখে বই এগিয়ে দিচ্ছেন সুধন্যদা।

সুধন্য সরকার, ভাস্করের দেওয়া নামে পরিচিত এই মানুষটি একজন কবিও। ধ্যানবিন্দুর বাইরে তাঁকে আমরা চিনি জীবনে বেঁচে থাকার যুদ্ধে, যিনি শুধু শব্দ জোড়া দেবার চেষ্টা করেন মাত্র। নিজেই বলেন, কবি হবার চেষ্টা তাঁর নেই। বাঁচার জন্য লড়াইয়ে যেটুকু শব্দ নিয়ে খেলেন, সেটুকুই তাঁর কবিতা। ভাস্কর ছিলেন মাস্টারমশাই এবং পিতৃসম। সকালে আড্ডা মারতে গেলে জলখাবার খাওয়ানো ছিল ভাস্করের দায়িত্ব। বাংলা নিয়ে সমস্যা হলে, ভাস্কর ঠেলে দিতেন সুমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ভরসা ভাস্করের স্ত্রী অর্থাৎ বাসবী চক্রবর্তী।

ধ্যানবিন্দু তখনও চালু হয়নি। নীল অপেরা বলে একটি কাগজ করতেন অভীক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুমন্ত মুখোপাধ্যায়। ভাস্কর চক্রবর্তী কবিতা বেছে দিলেন সুধন্যদার। নীল অপেরা দিয়ে কবিতার শুরু। সুব্রত সরকার নামের অন্য আরেকজন কবি আছেন বলে, ভাস্কর কাগজে নতুন নাম লিখে দিলেন - 'সুধন্য'।

লেখালিখির এই জগতকে সুধন্যদার মতো ভালো খুব কম লোকই বাসেন। প্রত্যেকের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার তাঁর। দিন কাটে হাজার বইয়ের ভিড়ে। কোথায় কী পাওয়া যাবে, তা তাঁর নখদর্পণে। অনেক ছোট পত্রিকা ও বইয়ের প্রকাশক আছেন, যাঁরা জানেন, সুধন্যদার দায়িত্বে বই থাকলে চিন্তা নেই কোনো। এভাবেই আমাদের জন্য সবসময় হাজির সুধন্যদা। আমরাও পাশে আছি তাঁর। আর আছে ধ্যানবিন্দু। 'বাঙালির আত্মানুভবের স্পন্দন'।

যদি বলি সেই স্পন্দনটিকে দুহাতে আগলে রেখেছেন এই মানুষটিই, খুব ভুল বলা হবে কি?

Latest News See More