বাড়ি, অফিস বা রাস্তা - আমরা সবাই সম্ভাব্য প্রিয়াঙ্কা

ভারতের একটি নির্দিষ্ট দিনের কিছু ঘটনা জানাই আপনাদের। বছর ছাব্বিশের প্রিয়াঙ্কাকে গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে দেওয়া হল হায়দ্রাবাদে। রাঁচিতে পঁচিশের আইনের ছাত্রীকে গানপয়েন্টে বারোজনের গণধর্ষণ। কুড়ির দলিত মেয়ে রোজাকে ধর্ষণ করে ঝুলিয়ে দিল কাঞ্চিপুরম, তামিলনাড়ুতে। বত্রিশের মহিলাকে বাড়ি ফেরার পথে আত্মীয়ের সঙ্গে গণধর্ষণ পাঁচ যুবকের, তামিলনাড়ুতেই। গুজরাটের ভাদোদারায় চোদ্দ বছরের কিশোরীকে গণধর্ষণ। এগারোর শিশুকে তিনদিন আটকে ধর্ষণ চণ্ডীগড়ের অটোচালকের। একই দিনে হয়েছে এতসব ঘটনা। একুশ শতকের ‘উন্নত’ ভারতে।

সম্প্রতি হায়দ্রাবাদে প্রিয়াঙ্কা রেড্ডির গণধর্ষণ ও নৃশংস হত্যা উঠে এসেছে শিরোনামে। তারই সুবাদে উল্লিখিত হচ্ছে অন্যান্য ঘটনাও। নইলে হয়তো ধামাচাপাই পড়ে যেত। নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে, জানত না আমজনতাও।

এর প্রতিক্রিয়া কী হচ্ছে? সোশ্যাল মিডিয়ায় নাগাড়ে প্রতিবাদ, কবিতা-গান-বিক্ষোভ। একের পর এক স্ট্যাটাস। ক্ষুব্ধ মানুষের অসহায় চিৎকার। ভার্চুয়াল প্রতিবাদে মুখর দেশের মানুষ। পথেও নামছেন কেউ কেউ, নামবেনও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে এর প্রতিবাদ? আমজনতার ক্ষমতাই বা কতটুকু। যাদের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে ধর্ষণের প্রবৃত্তি, তারা কতটুকু ‘উন্নত’ হয় এইসব প্রতিবাদের ফলে?

এই অপরাধীদের যোগ্য শাস্তি হয় কি? মামলা ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। ‘বেটি বঁচাও, বেটি পড়াও’, কথাটা কানে ভাসছে। হ্যাঁ বেঁচেই তো আছে মেয়েরা। কোনোভাবে দয়া, অনুগ্রহে বেঁচে। নির্ভয়া, রানাঘাট, আসিফা, কী করতে পেরেছি আমরা? যথাযোগ্য শাস্তি পেয়েছে কেউ? জুভেনাইল বলে ছাড় পেয়েছে সেই সতেরোর কিশোর। যে ধর্ষণ করে সে নাকি জুভেনাইল। এমন বিচারে আস্থা রেখে কোনো লাভ নেই।

আজো মা-বাবা বলেন ‘এই জামাটা ছোটো, অন্যকিছু পর।’ ট্রেনে মন্তব্য ভেসে আসে, পোশাকই নাকি ধর্ষণের শিকার হওয়ার জন্য দায়ী। বাসে-ট্রেনে-মেট্রোয় মেয়েদের ওপর যৌন নিগ্রহের কথা তো ছেড়েই দিলাম। চারদিকে ‘পৌরুষ’ প্রকাশ করার চেষ্টা। যেন নিজের পৌরুষ না প্রদর্শন করতে পারলে সার্থকতা নেই। আর অনেক ক্ষেত্রেই পৌরুষ শুধুমাত্র মেয়েদের অবদমন করা হিসেবেই দেখা যায়।

আসিফা ছিল সাত-আট বছরের শিশু। তার দোষ পোশাকের? নির্ভয়া রাতে বাড়ি ফিরছিল তার বন্ধুর সঙ্গে। অত রাত হয়েছিল, পুরুষ বন্ধু ছিল। সমাজের সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। যে অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর ঘটনার মূল অভিযুক্ত সে জুভেনাইল বলে পাঁচ বছরের জেল সেরে বেরিয়ে এসছে। মনীষা পৈলানকে অ্যাসিড ছুঁড়ে মেরেছিল যারা, তারা আজও পৃথিবীর মুক্তমঞ্চে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বুক ফুলিয়ে। এই আমাদের ভারতবর্ষ। যেখানে একজন সত্তরের মিশনারীকে ধর্ষণ করা যায়। সদ্যোজাত কিংবা ছোট শিশুকে স্রেফ ধর্মের জন্য ধর্ষণ করা হয়। শুধু মুখ বন্ধ করার জন্য একটি মেয়েকে মেরে ফেলা যায়। স্রেফ নিজের মা-বোন ছাড়া পৃথিবীর সাত থেকে সত্তর এদের কাছে ‘মেয়েছেলে’। তারা গলা উঁচু করলেই, পৌরুষ এগিয়ে আসবে এঁদের ছিন্নভিন্ন করতে।

আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি ধর্ষণের শিকার। কেউ বা মানসিক কেউ বা শারীরিক। কেউ বা দুটোই। খুব কম মেয়েই আছেন যারা তা অনুভব করেননি। বড়ো হবার পথে হাজারো নিষেধাজ্ঞা। বয়ঃসন্ধির প্রাককাল থেকেই শুনেছি মা-ঠাকুমার কাছে, আর যেন ছেলেদের সঙ্গে একা ঘরে না বসি। কোনো লোক গায়ে হাত দিলে জানাই। যেন যাকে-তাকে গায়ে না হাত দিতে দিই। খুব কাছের মানুষরাই যখন তাদের আদিম নখ দাঁত বার করে আনে, তখন ছোটো একটা বাচ্চার কথা কেউ শোনে না। বাসের ভিড়ে একটা হাত যখন সদ্য শরীরের মহিলা হবার লক্ষণে হাত বুলিয়ে সরে যায়। বাসের ভিড়ে পুরুষাঙ্গ ঘেঁষে আসে শরীরের কাছে।

বাড়ির দারোয়ানের কোলে তোলার নাম করে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ানোর চেষ্টা, বিহারী মালবাহকের অসভ্যতা – চলতি জীবনে এড়ানো যায় না কিছুই। দিনের পর দিন যখন ড্রাইভার স্কুলে নিয়ে যাবার সময় শরীরের বিভিন্ন অংশে হাত দিত, অসহায় লাগত খুবই। অথচ নিজের বাড়িতেই শুনতে হত ঠাকুমার কাছে - তোকেই সবাই এরকম করে কেন? তুই নিশ্চয়ই সুযোগ দিস। হ্যাঁ আমরাই তো সুযোগ দিই নিজেদের উপর এই অত্যাচার করানোর জন্য! বাড়িতে নিজেরই আত্মীয় যখন শরীরে বিভিন্ন ছলছুতোয় হাত দেয়, কর্পোরেট অফিসের বস যখন ক্ষমতার জোরে ছুঁয়ে যায় শরীরের ইতিউতি, এসব তো মেয়েদেরই দোষ! অন্তত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অধিকাংশ এমনটাই ভাবতে ভালোবাসে। সমাজের নিম্নস্তর থেকে উচ্চবিত্ত পরিবেশ – কোথাও দৃশ্যের বদল নেই একটুও। আসল বিষয় হল প্রবৃত্তি। ধর্ষণের মানসিকতা কোনো সামাজিক স্তর বিশেষে জন্মায় না। জন্মায় না ধর্ম দেখেও। এ এক বিকৃতি, ধর্ম-বর্ণ-অবস্থান নির্বিশেষে যার শিকার মেয়েরা। আর মেনে নিতে নিতে, একসময় নিজেদের গুটিয়ে ফেলা – এই-ই তো পরিণতি বেশিরভাগ জনের!

হ্যাঁ, এগুলোও ধর্ষণ। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার শরীরে ছোঁয়াটুকুও ধর্ষণ। নিজেকে কারোর জন্য অসহায়ভাবে বদলে ফেলাটুকুও একধরনের বিসর্জন। আমাদের বিসর্জন রোজ হয়। প্রতিটা দিন-রাত। প্রতিদিন আমরা প্রত্যেকে জলে ভেসে যাচ্ছি। গলে যাচ্ছে মেদ-মাংস, বেরিয়ে আসছে কাঠামো। পরিণতির দিক দিয়ে আলাদা কিছু খুঁজে পাই না...