কুমিরদের মধ্যে সবচেয়ে বিপন্ন ঘড়িয়াল, প্রয়োজন বিশেষ সংরক্ষণ

দীর্ঘ সরু চোয়াল। আর তার অগ্রভাগে অনেকটা বলের আকারের নাক। গঙ্গা, বিশেষত সুন্দরবনের নদী ও খাড়িগুলিতে হামেশাই দেখা মেলে এই সরীসৃপ প্রাণীটির। ঘড়িয়াল (Gharial)। কুমির গোত্রের প্রাণী হলেও সামুদ্রিক কিংবা নীল নদের দৈত্যাকার কুমিরের সঙ্গে বেশ কিছু চারিত্রিক পার্থক্য রয়েছে এই প্রাণীটির। তাদের আকারও নিতান্তই ছোটো। তবে মানব সভ্যতার জেরে এবার বিলুপ্ত হতে বসেছে এই প্রজাতিটি। তেমনটাই উঠে এল সাম্প্রতিক গবেষণায়।

এই গবেষণার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন লন্ডন জুওলজিক্যাল সোসাইটির গবেষক ফোবি গ্রিফিথ। অবশ্য তাঁর এই গবেষণার সূত্রপাত হয় নেপাল ও ভারত ভ্রমণ করতে এসেই। মূলত দুটি ঘড়িয়াল প্রজাতি নজর কেড়েছিল তাঁর— ‘গ্যাভিয়ালিস গাঙ্গেটিকাস’ এবং ‘ক্রোকোডাইলাস প্যালুস্ট্রিস’। প্রথমটির বসবাস গঙ্গা ও তার উপনদী-শাখানদীতে, দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় নেপালের মিষ্টিজলে। মূলত মাছ শিকার করেই জীবন নির্বাহ করে এই দুটি প্রজাতি। বলতে গেলে, কুমিরদের মধ্যে সবচেয়ে স্বতন্ত্র প্রজাতিও ঘড়িয়াল। 

পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে গ্রিফিথ লক্ষ করেন, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ঘড়িয়ালদের গুরুত্ব অপরিসীম। নদীর মাছ খেয়ে জীবন নির্ধারণ করে বলে, এই প্রজাতিটিকে শত্রু বলেই মনে করেন মৎস্যজীবীরা। ফলে, মাছ ধরার জালে বন্দি হলে অনেক সময় প্রাণ হারাতে হয় ঘড়িয়ালকে। তবে বাস্তব ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে-সকল অঞ্চলগুলিতে ঘড়িয়ালের সংখ্যা বেশি, সেই অঞ্চলের নদীতে বিভিন্ন প্রাজাতির মাছের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ, জীববৈচিত্রের সমীকরণ রক্ষায় বিশেষভাবে সহায়তা করে ঘড়িয়াল। কিন্তু কীভাবে? গ্রিফিথে মতে, সাধারণত আকারে বড়ো মাছেদেরই শিকার করে এই সরীসৃপ। অন্যদিকে এই সকল মাছ সদ্যজাত মাছ অর্থাৎ মীন খেয়ে জীবনধারণ করে। ফলে, হ্রাস পায় মাছের সংখ্যা।

গোটা নেপালে বর্তমানে অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ২০০টি ঘড়িয়াল। ভারতেও সংখ্যাটা হাজারের কম। একদিকে যেমন নদীতে ড্যাম ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির কারণে কমেছে তাদের সংখ্যা, তেমনই রয়েছে চোরাশিকারিদের উৎপাত। সবমিলিয়ে বিলুপ্তির প্রমাদ গুনছে এই প্রজাতিটি। তার নাম রয়েছে রেড লিস্টেও। কিন্তু তার পরেও ঘড়িয়াল সংরক্ষণে সেভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কোথাও। বরং, সামুদ্রিক কুমিরের কৃত্রিম প্রজনন ও সংরক্ষণের বিষয়ে বেশি আগ্রহ প্রশাসনের।

এই বিষয়টি মাথায় রেখেই সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন গ্রিফিথ। যা মূলত বিশ্বের মোট ২৮টি কুমির প্রজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে তৈরি একটি বিশেষ তথ্যভাণ্ডার। সেখানে যেমন তাদের দৈহিক আকার-আয়তনের বর্ণনা রয়েছে, তেমনই রয়েছে তাদের স্বভাব-চরিত্র এবং জনসংখ্যার পরিসংখ্যানও। শুধু তাই নয়, কোনো প্রজাতিগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রয়োজন, সেই তালিকাও প্রস্তুত করেছেন তিনি। ঘড়িয়াল ছাড়াও এই তালিকায় রয়েছে চাইনিজ ও কিউবান অ্যালিগেটর, ওরিনোকো ক্রোকোডাইলের মতো প্রজাতিও। গ্রিফিথের এই গবেষণাকে ইতিমধ্যেই স্বীকৃতি জানিয়েছে আইইউসিএন। আগামীদিনে বিলুপ্তপ্রায় কুমির প্রজাতির সংরক্ষণ অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠবে এই গবেষণাপত্র, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা… 

Powered by Froala Editor