শুধু ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-ই নয়, বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হতে হয়েছে এই গ্রন্থগুলিকেও

/৮

গত ১২ আগস্টের কথা। নিউইয়র্কে বক্তৃতা দেওয়ার সময় আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন লেখক সালমান রুশদি। তারপরই ফের নতুন করে চর্চায় উঠে এসেছে সাহিত্যে সেন্সরশিপের প্রসঙ্গ। ১৯৮৮ সালে তাঁর লেখা ‘স্যাটানিক ভার্স’ সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বে। বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল ব্যাপক বিক্ষোভ। ফতোয়া জারি করেছিল ইরান।

/৮

সে-সময় একাধিকবার আক্রান্ত হয়েছেন রুশদি। আততায়ীর হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে এই গ্রন্থের জাপানি অনুবাদক ও নরওয়েজিয়ান প্রকাশককেও। এমনকি এখনও পর্যন্ত ইরান, ভারত, কেনিয়া-সহ একাধিক দেশেই নিষিদ্ধ এই গ্রন্থ। কিন্তু শুধুই কি ‘স্যাটানিক ভার্স’? বিগত এক শতকে বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে একাধিক গ্রন্থসাহিত্য। কখনও তার পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক, আবার কখনও ধর্মীয় কারণ। এক-ঝলকে দেখে নেওয়া যায় এইসকল নিষিদ্ধ গ্রন্থদের…

/৮

লোলিতো— সোভিয়েত লেখক ভ্লাদিমির নাবোকভের লেখা এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৫ সালে। স্বপ্লবয়সী তরুনীর সঙ্গে এক পেডোফাইলের সম্পর্ককে এই গ্রন্থে ফুটিয়ে তুলেছিলেন ভ্লাদিমির। তবে এই গ্রন্থ প্রকাশে রাজি ছিলেন না সোভিয়েতের প্রকাশকরাও। নিষিদ্ধ গ্রন্থের প্রকাশক হিসাবে খ্যাত জন্য ফরাসি প্রকাশ মরিস গিরোডিয়াস দায়িত্ব নেন এই বই ছাপার। রুশ-গ্রন্থ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তা নিষিদ্ধ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক গ্রাহাম গ্রিন দীর্ঘদিন লড়াই করেছিলেন ব্রিটেনে এই গ্রন্থের ছাড়পত্র জোগাড়ের জন্য। প্রচার চালিয়েছিলেন, ইউরোপের দুর্নীতির রূপক এই গ্রন্থ। ১৯৬২ সালে স্ট্যানলি কুব্রিকের সিনেমা-রূপান্তরের পর বইটির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় ব্রিটেন-সহ বেশ কয়েকটি দেশ। তবে আজও মার্কিন স্কুল ও লাইব্রেরিতে নিষিদ্ধ এই গ্রন্থ।

/৮

অ্যানিম্যাল ফার্ম— ১৯৪৫ সাল। জর্জ অরওয়েলের কলমে ধরা পড়েছিল স্তালিন-শাসিত সোভিয়েত ইউনিয়নের দমন-পীড়নের ছবি। রুশ স্বৈরশাসককে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে বিদ্ধ করেছিলেন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র— উভয় দেশেই নিষিদ্ধ হয় এই গ্রন্থ। আশঙ্কা করা হয়েছিল হিটলারের বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির জোটকে প্রভাবিত করতে পারে এই গ্রন্থের পটভূমি। অবশ্য পরবর্তীতে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েতকে সমালোচনায় বিদ্ধ করে গ্রন্থটিকে ছাড়পত্র দিয়েছিল দুই দেশই। অন্যদিকে সোভিয়েত পতনের আগে পর্যন্ত সেখানেও নিষিদ্ধ ছিল এই বই। শূকরকে মূল চরিত্রে দেখানোর জন্য, পরবর্তীতে এই বইটি নিষিদ্ধ করে সংযুক্ত আমির আমিরাত।

/৮

ট্রপিক অফ ক্যানসার— ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয় হেনরি মিলারের এই কালজয়ী তথা বিতর্কিত গ্রন্থটি। প্রকাশের তার আগেই প্যারিসের লেখক ও জোঙ্কার্স রেয়ার বুকস-এর কর্ণধার টম আইলিং জানিয়েছিলেন, এই গ্রন্থ আদৌ প্রকাশযোগ্য কিনা নিশ্চিত নন তিনি। হিংসাত্মক যৌন দৃশ্য এবং মিসোজিনিস্ট ভাষার ব্যাপকতার কারণেই বিভিন্ন জায়গায় চর্চিত হয়েছিল এই গ্রন্থটি। ১৯৩৪ সালেই এই গ্রন্থকে নিষিদ্ধ করে মার্কিন কাস্টমস। তবে কালোবাজারের দৌলতে গোটা যুক্তরাষ্ট্রে ছেয়ে গিয়েছিল এই বই। অবশেষে ১৯৬৪ সালে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তবে তারপরেও সম্পূর্ণ কলঙ্কমুক্ত হতে পারেনি ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’। ১৯৮৬ সালে তুরস্ক নিষিদ্ধ করে এই ঔপন্যাসকে।

/৮

লেডি চ্যাটারলি’স লাভার— যৌন দৃশ্য এবং বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর মধ্যে নিষিদ্ধ সম্পর্কের বর্ণনার জন্য গ্রন্থটির প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে যুক্তরাজ্যের প্রশাসন— গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি পড়েই লেখক ডিএইচ লরেন্সকে এই পরামর্শ দেন তাঁর এজেন্ট। হয়ও তেমনটা। গ্রন্থ প্রকাশে সে-সময় রাজি হয়নি কোনো ব্রিটিশ প্রকাশকই। অবশেষে ইতালীয় এক প্রকাশকের মাধ্যমে সীমিত সংখ্যায় প্রকাশ পায় এই বই। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ পাঠকদের স্পর্শ পায়নি এই গ্রন্থ। সে-বছর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করে গ্রন্থটিকে দেশে ফিরিয়ে আনে পেঙ্গুইন বুকস। প্রথম দিনেই এই বই বিক্রি হয়েছিল ২ লক্ষ কপি। ১৯৮৭ সালে এই গ্রন্থের ওপর পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয় চিনে।

/৮

ইউলিসিস— গ্রন্থ হওয়ার আগে মার্কিন পত্রিকা ‘দ্য লিটল রিভিউ’-তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছিল জেমস জয়েসের এই উপন্যাসটি। কিন্তু হস্তমৈথুনের দৃশ্য থাকার কারণে হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় ইউলিসিস। কার্যত গোটা দেশ অশ্লীলতার অভিযোগ তুলেছিল জেমস জয়েসের দিকে। ১৯২২ সালে তাঁর এই উপন্যাস প্রকাশ করতে রাজি হয় প্যারিসের এক প্রকাশক। মার্কিন পোস্টাল সার্ভিস ও ব্রিটিশ বন্দরে সে-সময় পোড়ানো হয়েছিল গ্রন্থটির হাজার হাজার কপি। তা সত্ত্বেও কালোবাজারে রীতিমতো জনপ্রিয়তা ছিল এই বই। অবশেষে ১৯৩৩ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেয় গ্রন্থটির ওপর থেকে। ‘ইউলিসিস’ হয়ে ওঠে আধুনিকতাবাদী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনা। তবে আজো ইরানে নিষিদ্ধ এই গ্রন্থ।

/৮

১২০ ডেস অফ সডোম— ১৯০৪ সালে জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এই গ্রন্থ। অবশ্য ‘১২০ ডেস অফ সডোম’ লেখা হয়েছিল তারও ১২০ বছর আগে। ফরাসি বিপ্লবের সময় বাস্তিলে বসে এই গ্রন্থটি লেখা শুরু করেছিলেন মারকুইস ডি সাডে। কিন্তু শেষ করতে পারেননি এই গল্প। তার আগেই আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে হিংসা, বিদ্রোহ। এই গ্রন্থটিরও ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে বিকৃত ও হিংসাত্মক যৌনতা, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, নির্যাতন ও পেডোফিলিয়া। ১৯০৪ সালে জার্মানিতে প্রকাশিত হলেও, বিশ শতকে অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশেই নিষিদ্ধ ছিল এই গ্রন্থ। পরবর্তীতে পাওলো পাসোলিনি এই গল্পকে চলচ্চিত্রের রূপ দিলে, তাও নিষিদ্ধ হয় বহু দেশে। আজও সাহিত্যজগতের কুখ্যাত কিংবদন্তিগুলির মধ্যে অন্যতম এই ফরাসি গ্রন্থ…

Powered by Froala Editor