একজন এক্স-সোলজার

পাড়ায় শৈলেশবাবু ভাড়া এসেছেন বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল। সঙ্গে স্ত্রী, চার ছেলেমেয়ে। গায়ের রং মিশকালো, বড়বড় চোখ, লম্বাচওড়া চেহারা, সারাগায়ে লোম ভর্তি, মাথার চুলে ব্যাকব্রাশ। স্যার আশুতোষের মতো সম্ভ্রমজাগানো একজোড়া গোঁফ। ছেলে নাউন-প্রোনাউনের সংজ্ঞা ঠিকমত না বলতে পেরে যখনতখন ঠ্যাঙানি খায় বাপের হাতে। বাড়িঅলা মধ্যস্থতায় এলে শৈলেশবাবু তাকে শুনিয়ে দেন তাঁরাও পঞ্চাশ ভাই তাঁদের বাবার হাত-পা বেঁধে ঘরের ছাদে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা শাসন সহ্য করেই মানুষ হয়েছেন। তিনিও চান তাঁর ছেলে মানুষের মতো মানুষ হোক, লোকে বলুক হ্যাঁ শৈলেশ চক্রবর্তীর ছেলে বটে।

এদিকে দিন যায়, পাড়ায় শৈলেশবাবুর একটা একটা করে দিন কাটতে থাকে। তাঁর গোঁফজোড়া দেখে পাড়ার মেয়ের দল হাসিঠাট্টা করে। শৈলেশবাবু যথেষ্ট বিরক্ত হন এইসবে। তিনি কি আর যে সে লোক নাকি! স্টিমার অফিসের মরিসন সাহেবের সঙ্গে তাঁর কি খাতিরটাই না ছিল। তাছাড়া ক্যালকাটা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বীরেন মুখার্জী তাঁর আপন মাসতুতো ভাই। আর অজিত বসাক নামে যে ছেলেটা বিলেতে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড়তে গেল ক'দিন আগে সেও তাঁকে ভয়ানক সম্মান করত। তাছাড়া বিগত মহাযুদ্ধের তিনি একজন এক-সোলজার। হেলেফেলা নাকি? বাড়িওয়ালা শুনে অবাক হন। শৈলেশবাবু বলেন, কী তাঁর দায় পড়েছিল যুদ্ধে যাবার! পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে দিন কাটাতেই পারতেন। তাঁর কি টাকাপয়সার অভাব? বাড়িঅলা ভাবেন বড় অমায়িক লোক তো, যা মনে হয় তাই মুখে বলে ফেলেন। শৈলেশবাবু চলে যান। গিয়ে আবার ছেলে পেটান, বউকে মন দিয়ে ভালবাসেন, সংসার করেন চুটিয়ে।
ক'দিন পর খবর আসে, শৈলেশবাবু রাস্তায় কার সঙ্গে মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে গেছেন। খবর শুনে চমকে ওঠেন বাড়িওয়ালা, কিন্তু অবাক হন না। দেখতে যান হাসপাতালে। ওনাকে দেখে শৈলেশবাবু খুশি হন।

বলেন, চায়ের দোকানের ব্যাটারা কী এক সামান্য বিষয় নিয়ে তর্ক শুরু করে শেষ পর্যন্ত হাতাহাতি পর্যন্ত নিয়ে গেল ব্যাপারটাকে। পঁচিশজন মিলে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াল। তবু যা মার তিনি দিয়েছেন একেকটাকে সারাজীবন তারা মনে রাখবে। আর তাঁর তো শুধু মাথাটাই ফেটেছে আর এদিকওদিক চোট লেগেছে সামান্য, তেমন কিছু না। মার দিতে গেলে অল্পস্বল্প মার তো খেতেই হবে নাকি! আর ব্যাটারা তাঁকে ওদেরই মতো হেলেফেলার লোক মনে করেছে। ভুলে গেছে যে শৈলেশবাবু একজন এক্স-সোলজার। সারাজীবন এরকম মাথা উঁচু করে বেঁচেছেন বলেই না লোকে তাঁকে এত ভয় করে, সম্মান করে চলে এখনো। আর কোথাকার এক চালচুলোহীন চায়ের দোকানের ছোকরা! বাড়িওয়ালা সব শুনে চলে যাচ্ছিলেন, শৈলেশবাবু পেছন থেকে ডাকেন। অনুযোগ করেন, তাঁকে কেউ যত্নই করছে না। নার্স, জুনিয়র ডাক্তাররা সবাই ভাবছে উনি বোধহয় একজন সাধারণ লোক, জানে না তো, তিনি ফালতু লোক নন, রীতিমতো একজন এক্স-সোলজার।

উনি চলে যান। কিছুদিন পর শৈলেশবাবু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরে আসেন। বাড়িঅলার কাছে এসে বলেন, হাতে একটিও পয়সা নেই। খাবেন কী? ক'টা পয়সা দিলে ভালো হত। ইংরেজি মাস পড়লেই শোধ করে দিয়ে যাবেন। আরো বলেন, "সেদিন মিথ্যে কথা বলেছিলাম। চায়ের দোকানে অনেকদিনের টাকা বাকি পড়ে গেছিল তো, তাই আর কি! ক'টা টাকা যদি দেন!" বাড়িঅলা বিরক্ত হয়ে বলেন, "শৈলেশবাবু, বাড়িভাড়াও দেননা, উল্টে আবার পয়সা চাইতে এসেছেন!" শেষমেশ কিছু টাকা দেন কিন্তু পরদিনই বাড়ি ছেড়ে উঠে যেতে বলেন। বলেন, "ও টাকা আর ফেরত দিতে হবে না। শুধু বাড়িটা ছেড়ে দিলেই চলবে।" পরদিন সকালে শৈলেশবাবু সপরিবারে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। যাবার আগে গোঁফে হাত বোলাতে বোলাতে বলে যান, "এক্স-সোলজার অফ দ্য লাস্ট গ্রেট ওয়ার"।

ওপরের বর্ণনাটি সোমনাথ চন্দের একটি গল্পের বিষয়বস্তু থেকে নেওয়া। এভাবেই একে একে রঙ্গমঞ্চ থেকে চলে গেলেন মহাযুদ্ধের প্রাক্তন সৈনিকেরা। যেমনভাবে চলে গেছেন সোমেন চন্দ, চলে গেছেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। এঁরা সবাই ছিলেন মহাযুদ্ধের একেকজন রণক্লান্ত সৈনিক। অথবা বলা যায় মহাযুদ্ধের একেকজন রণক্লান্ত শিল্পী। মহাযুদ্ধই এঁদের জন্ম দিয়েছিল, মহাযুদ্ধই কেড়ে নিয়ে গেল সবাইকে। ১৯২০ সালে পূর্ববঙ্গের নরসিংদীতে জন্ম হয়েছিল সোমেন চন্দের। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। যুদ্ধের ফলস্বরূপ দেশে দেশে দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব, অনাহার, অপুষ্টি, মৃত্যু। দোসর হল মহামারী। রাশিয়ায় টাইফাসে প্রাণ দিল তিরিশ লাখ মানুষ। ম্যালেরিয়ার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ল। ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর রূপ নিয়ে প্রাণঘাতী হল পাঁচ কোটি মানুষের জীবনে। পৃথিবীব্যাপী অর্থনীতি হল ভূলুণ্ঠিত। সুযোগসন্ধানী ক্ষমতালোভী রাষ্ট্রনেতা এবং তাদের সঙ্গী কুটিল মুনাফাবাজ ব্যাবসায়িক গোষ্ঠী এই সুযোগে হল আরো ধনী আর গরিবদের মাথার ওপর ধীরেধীরে আস্তরণ বিস্তার করল দারিদ্র্যের করাল ছায়া।

গরিব-বড়লোকদের ফারাক সুস্পষ্ট হতে থাকল প্রতিদিন। শোষণ এল নিত্যনতুন রূপ নিয়ে। কম্যুনিজম প্রভাববিস্তার করল সমাজে সাধারণ মানুষের দুঃখ ভোলাতে। ১৯২৬ সালে কলকাতায় জন্ম নিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। পরবর্তীকালে বাম আমলে যিনি কুড়ি বছরের জীবন শেষ হবার বহুযুগ পরে রবীন্দ্র-নজরুলের সঙ্গে এক মঞ্চে পঠিত হবেন এবং অভিহিত হবেন 'কিশোর কবি' বলে।

এদিকে সোমেন চন্দ চারবছর বয়সে মাকে হারিয়ে বৈমাত্রেয় ভাইবোনেদের সঙ্গে বড় হয়ে উঠতে থাকেন। গ্রামের কৃষিনির্ভর জীবন ছেড়ে বাবা জ্যাঠা দু'জনেই ঢাকা শহরে চলে আসলে সোমেন ঢাকা সদরঘাটের পোগোজ স্কুলে ভর্তি হন বারো বছর বয়সে, ক্লাস সিক্সে। ১৯৩৬-এ ম্যাট্রিক পাশ করে ডাক্তারি পড়তে ঢোকেন। কিন্তু অর্থাভাবে এবং প্লুরিসির আক্রমণে শারীরিক অবস্থা বেহাল হয়ে পড়ায় সোমেনের পড়া থেমে যায়। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করবে আর কয়েক বছরের মধ্যেই। পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধবাজ দেশ রণসজ্জায় সজ্জিত হচ্ছে ক্রমশ। সোমেন সেইসব নিয়ে বাবার সঙ্গে আলোচনায় মেতে ওঠেন। যুদ্ধ নিয়ে কথা হয়, যুদ্ধের পটভূমি নিয়ে, যুদ্ধপরবর্তী প্রভাব নিয়ে, অর্থনীতি নিয়ে, সমাজনীতি নিয়ে আলোচনা চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সোমেনের মনন গড়ে উঠতে থাকে বাবার সঙ্গে নিরন্তর চর্চায়। সোমেন ধীরেধীরে জড়িয়ে পড়েন রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে। ঢাকার কম্যুনিস্ট আন্দোলনের প্রকাশ্য শাখা 'প্রগতি পাঠাগার' পরিচালনার ভার পান সোমেন। বই পড়া বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে চলে সমাজতত্ত্বের অনন্ত পাঠ। কম্যুনিস্ট ভাবধারার সঙ্গে নিজের জীবনদর্শন আদ্যোপান্ত জড়িয়ে ফেলে সোমেন। কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হয় মাত্র একুশ বছর বয়েসে। তখন ১৯৪১ সাল। তখন পার্টির সদস্যপদ খুব একটা সহজলভ্য নয়।

এইসময় থেকেই লেখক সোমেন চন্দের যাত্রা শুরু হয়। ঢাকার প্রগতি লেখক সঙ্ঘের প্রধান সংগঠক হন সোমেন। ট্রেড ইউনিয়নের ক্রিয়াকলাপের পাশাপাশি সঙ্ঘের সাপ্তাহিক বৈঠকে কারা লেখা পড়বে সেসমস্ত নির্বাচনের দায়িত্ব পড়ে তাঁর কাঁধে। কোনো-কোনোদিন তিনিও পকেটে পুরে একখানা করে লেখা আনতে শুরু করলেন। সোমেন চন্দের লেখা গল্পের অধিকাংশই সঙ্ঘের এই সাপ্তাহিক অধিবেশনে পঠিত ও আলোচিত। এছাড়া কম্যুনিস্ট আন্দোলনের অঙ্গরূপে মজুরদের বস্তিতে, কারখানার গেটে, ইঞ্জিন শেডের কাছে কালো ধোঁয়ার নিচে দাঁড়িয়ে শোষিত শ্রেণীর সঙ্গে আলাপ করে তাদের একজোট করার কাজে নিজেকে নিয়জিত করেন সোমেন। ঢাকার প্রথমসারির নেতৃবৃন্দ তখন বন্দি হয়ে কারান্তরালে। সোমেনের মতো তরুণদের কাঁধে গুরুদায়িত্ব। ১৯৪২ সালের ৮ই মার্চ ঢাকার সোভিয়েত সুহৃদ সঙ্ঘের পরিচালনায় সংগঠিত সর্বভারতীয় ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে রেলকলোনি থেকে রেলশ্রমিকদের মিছিল নিয়ে আসতে গিয়ে হানাদারের মর্মান্তিক আঘাত নেমে আসে। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় স্বপ্নদর্শী তরুণ সোমেন চন্দকে। দুই চোখ উপড়ে ফেলে, জিভ টেনে বের করে, পেট চিরে নাড়িভুঁড়ি বের করে এনে নারকীয় উল্লাস চলে মৃতদেহ ঘিরে। তার ঠিক ছ’বছরের মাথায় যক্ষ্মার থাবা টেনে নিয়ে যাবে কবি সুকান্তকেও।

একুশ বছর বয়সে একজন কম্যুনিস্টের মৃত্যু হয়। বেঁচে থাকেন একজন লেখক। পরবর্তীকালে পাঠকমহলে তিনি সমাদৃত হবেন কম্যুনিস্ট লেখক হিসেবে। কিন্তু একজন লেখকের কোনো বিশেষণ হয় না, কোনো রং থাকে না তাঁর কলমের ডগায়। একজন লেখকরূপেই তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। ভাবীকাল তাঁর একমাত্র পরিচয় বয়ে নিয়ে যায়, তিনি শুধুই একজন অক্ষরকর্মী। আর প্রজন্মান্তরের পাঠক আবিষ্কার করে, তাঁর রচনাসম্ভারের বেশ কিছু সার্থক ছোটোগল্প রচনাশৈলীর দিক থেকে যুগের তুলনায় অতিমাত্রায় আধুনিক। বর্তমান সময়ে জন্মালেও বোধহয় তাঁর লেখার ধাঁচ বদলাতে হত না বড়ো একটা। কিন্তু বদলে যেত লেখার ভাব। বদলে যেত যুগের হুজুগ। শেষমেশ ক্রান্তিকালের মধ্যেই তাঁর জীবন সীমাবদ্ধ হয়ে থাকল। তিনি রয়ে গেলেন মহাযুদ্ধেরই একজন 'এক্স-সোলজার' হয়ে। যুদ্ধক্ষেত্রেই সৈনিকের মৃত্যু ঘটল, থেকে গেলেন লেখক সোমেন চন্দ অনন্তকাল মহাযুদ্ধের স্মৃতি বুকে নিয়ে।

More From Author See More