প্রেমেন্দ্র মিত্রের অস্থিরতা ও ‘সাগর থেকে ফেরা’

পড়াশোনায় ভালো ছিলেন। তবু কোনো বিষয়ে বেশিদিন টিকতে পারতেন না। সুস্থিরতার অভাব জীবনে। স্কটিশ চার্চে ভর্তি হলেন কলা বিভাগে। কখনও চিড়িয়াখানা, কখনও নদীর পারে কাটত সময়। কিছুদিন পর মনে হল, দেশ অবহেলায় পড়ে আছে। তাকে উদ্ধার করার জন্য আধুনিক বৈজ্ঞানিক কৃষিবিদ্যা শেখা দরকার। চলে গেলেন শ্রীনিকেতন। কিন্তু পিছু ছাড়ে না কলকাতার টান। ফিরে এসে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হলেন সাউথ সুবাবর্ন কলেজে। সময়টা ১৯২৩ সালের নভেম্বর মাস। হঠাৎ একদিন গোবিন্দ ঘোষ লেনের মেসের ধুলোভরা ঘরের এক টুলুঙ্গিতে খুঁজে পেলেন একটি পোস্টকার্ড। সম্ভবত আগের ভাড়াটের। অত্যন্ত সাদামাটা মধ্যবিত্ত জীবনের অভাব-অভিযোগের কথা। কৌতুক আর বিস্ময় থেকে তাঁর মাথায় জন্ম নিল গল্পের প্লট। লিখে ফেললেন ‘শুধু কেরানি’ আর ‘গোপনচারিণী’ গল্প দুটি। বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব ঘটল প্রেমেন্দ্র মিত্রের (Premendra Mitra)।

‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল গল্পগুলি। কলকাতায় তখন গড়ে উঠেছে ‘কল্লোল’ (Kallol) পত্রিকা। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, দীনেশ দাস-দের সঙ্গে প্রেমেন্দ্র মিত্রও জড়িয়ে পড়েছেন ‘আভ্যুদায়িক সঙ্ঘ’-এ। কিন্তু আবার চঞ্চল হয়ে উঠল মন। ডাক্তার হওয়ার জন্য চলে গেলেন ঢাকা। ঢাকার মেডিকেল স্কুলে ভর্তির চেষ্টা করলেন। সেখানে ঢাকার ছাত্ররাই অগ্রাধিকার পেত। ফলে তড়িঘড়ি ভর্তি হয়ে গেলেন জগন্নাথ কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে। থাকতেন অক্সফোর্ড মিশনের হোস্টেলে। বিশেষ অনুষ্ঠানে ইংল্যান্ডের জাতীয় পতাকা তোলা ছিল সেই ছাত্রাবাসের রীতি। প্রেমেন্দ্র মিত্রকেও ডাকা হল। এই কাজে অংশগ্রহণ করতে প্রবল আপত্তি জানালেন তিনি। আচরণের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমাও চাইলেন না। পত্রপাঠ বিতাড়িত হলেন সেখান থেকে। 

এদিকে প্রবলভাবে টানছে কলকাতা। ‘কল্লোল’-এর হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে নবযুগের আগমনবাণী ঘোষিত হয়ে গেছে। কল্লোলের বন্ধুগোষ্ঠী, উল্লসিত আড্ডা, বিভিন্ন পরিকল্পনা সব কিছুর অমোঘ আকর্ষণ এড়ানো বড়ো মুশকিল। তাঁর আরও কিছু গল্প ততদিনে প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। মুক্তির অপেক্ষায় প্রথম উপন্যাস ‘পাঁক’। ১৯২৫-এ কলকাতা ফিরবেন ঠিক করেও চলে যান চক্রবেড়িয়ায়। উনিশ টাকা বেতনের স্কুল শিক্ষকের চাকরি নিয়ে। ক্রমে চিড় ধরে ‘কল্লোল’-এও। দীনেশ দাশের সঙ্গে মুরলীধর বসুর ব্যক্তিত্বের সংঘাত তো ছিলই, অর্থনৈতিক কিছু বিবাদও ছিল। আর সেই বিরোধ থেকে পরের বছর জন্ম নেবে একটি নতুন পত্রিকা—‘কালিকলম’।

কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রতিষ্ঠা ‘কালিকলম’-এই। সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন পরবর্তীতে। কিন্তু এই মাঝের একটা বছর আরও অস্থির করে তুলল তাঁকে। কিছুদিন এদিক-ওদিক ঘুরে ছেড়ে চলে গেলেন কাশী। ১৯০৪ সালে এখানেই জন্ম তাঁর। পরে অবশ্য পারিবারিক সমস্যার জন্য চলে আসতে হয় ভাগলপুরে। কাশীতে সাহিত্যচর্চার উন্মুক্ত পরিবেশ। গঙ্গার ঘাট রয়েছে, কারমাইকেল লাইব্রেরি রয়েছে, আর রয়েছে বন্ধু বিনয় সেন। ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থের রচয়িতা দীনেশচন্দ্র সেনের (Dinesh Chandra Sen) পুত্র।

আরও পড়ুন
‘পর্নপুট’-এর জন্য প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘সাগর থেকে ফেরা’ কবিতাটি কপি করে দিলেন

দুজনের আলাপের গল্পটি বেশ মজার। একদিন জানতে পারলেন দীনেশচন্দ্রের এক ছেলে কাশীতে এসেছেন এবং তিনি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে দেখা করতে চান। দীনেশচন্দ্রের এক ছেলেকেই তিনি চেনেন। তাঁর নাম অরুণ সেন (কবি সমর সেনের পিতা), স্কটিশ চার্চ কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক। কিছুটা আগ্রহের সঙ্গেই বসে রইলেন তিনি। কিন্তু এলেন বিনয় সেন। ভেবেছিলেন বইপ্রকাশ নিয়ে কথা বলবেন, দিলেন চাকরির প্রস্তাব। তাঁর বাবার গবেষণা-সহায়কের কাজ। ১৯২৬-এ কলকাতায় ফিরে আস্তানা গড়লেন ‘কল্লোল’-এর অফিসে। 

আরও পড়ুন
ফেলুদার শহরে শার্লক হোমসের ঠেক; ঢুঁ মারতেন সুকুমার সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ, সমরেশ বসুরা

একদিন গেলেন বাগবাজারের বিশ্বকোষ স্ট্রিটের বাড়িতে দীনেশচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে। বাড়ির ভিতরের এক চাতালে একরাশ বই আর কাগজপত্রের মাঝে কোঁচার খুঁট গায়ে দিয়ে বসে আছেন স্বনামধন্য অধ্যাপক। “ইনিই দীনেশ সেন!” একটু হতাশই হলেন। পরে বুঝেছিলেন, আত্মভোলা জ্ঞানপাগল মানুষটির অন্তরে রয়েছে পরম স্নেহ। শুধু শিক্ষা নয়, ভালোবাসার সমুদ্রেও স্নান করেছিলেন তিনি। দীনেশচন্দ্র তখন আবিষ্কার করেছেন মৈমনসিংহগীতিকার আশ্চর্য লোককাব্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলো হিসেবে চলছে নিরন্তর গবেষণা। সেই কাজেই সহায়তা করবেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। বেতন ৭৫ টাকা। 

কিন্তু এ-কাজেও থাকতে পারলেন না। কারণ, সেই অস্থিরতা। দীনেশচন্দ্র একদিন বলেই বসলেন, “আমার কাছেই আপনি এ রকম করছেন, আপনি অন্য কোথাও চাকরি করবেন কী করে?” সবাইকে ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন তিনি। না, রাগ-বিরক্তি থেকে কথাগুলি বলেননি। খানিক ব্যথা আর করুণা মিশিয়েই বললেন কথাটা। আত্মগ্লানি গ্রাস করল প্রেমেন্দ্র মিত্রকে। যথাসর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন খামতিগুলি পূরণ করার। এই ‘অকর্মণ্য’ ছেলেটির প্রতি পুত্রস্নেহেও জড়িয়ে পড়েন দীনেশচন্দ্র। পরে বম্বে-তে একটি চাকরির জন্য চেষ্টা করেন। হয়নি সেই চাকরি।

ফলে আবার সেই বেকার অবস্থা। এদিকে ১৯২৬-এ আন্দামান থেকে ফিরে এসেছেন ‘আলিপুর বোমা মামলা’-র অভিযুক্তরা। পথ বদলে গেলেও জাতীয়তাবাদের আগুন সবার একই রকম আছে। বিনয় সেনের খুব উৎসাহ তাঁদের সঙ্গে দেখা করার। বারীন ঘোষের সঙ্গে দেখা হয়েছে, এবার যাওয়া হবে উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি আবার সবাইকে ‘তুই’ বলে ডাকেন। পাঁচ মিনিট কথা বলেই প্রেমেন্দ্র মিত্রের পারদর্শিতা বুঝে গেলেন উপেন্দ্রনাথ। হঠাৎ বললেন, “এই প্রেমেন! খবরের কাগজে চাকরি করবি?” আকাশ থেকে পড়লেন তিনি। আমতা আমতা করে জানালেন যে, রাজনীতির কিছুই তিনি বোঝেন না। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, “তাহলে তুই বেস্ট ম্যান!” সেই দিনই পেলেন বাংলার সেই সময়ের ‘প্রথম জাতীয়তাবাদী দৈনিক বাংলার কথা’-র সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব। সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ স্বয়ং।

অবশেষে সুস্থিরতার পথে এগোয় জীবন। বিয়েও করেন দুয়েক বছরের মধ্যে। কবি হিসেবে আসে খ্যাতি। ১৯৩০-এই শিশু সাহিত্যে প্রবেশ। ‘ঘনাদা’র আড্ডায় জমে ওঠে মেসের ঘর। পরে সিনেমা পরিচালনা, চিত্রনাট্য ও গীতরচনার বহু কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ছোটগল্প আর উপন্যাস তো রইলই। নোঙরে বাঁধা পড়ে জীবন। অস্থির মন ছুটে ছুটে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে কূলে। ‘সাগর থেকে ফেরা’ যেন সেই অবাধ, চঞ্চল, অগোছালো তরুণ জীবনের কাব্যরূপ হয়ে দেখা দেয়।

তথ্যঋণ:
নানা রঙে বোনা, প্রেমেন্দ্র মিত্র
কল্লোলযুগ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুমিতা চক্রবর্তী

Powered by Froala Editor