উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয়ের কারণ কী? বিস্তারিত গবেষণাপত্র প্রকাশ বিজ্ঞানীদের

চলতি ৭ ফেব্রুয়ারি। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১০টা বেজে ২১ মিনিট। হিমালয়ের রন্টি শৃঙ্গের উত্তর দিকের ঢাল থেকেই খসে গেল বিশালাকার একটি পাথরের টুকরো। যার ওপরে জমে ছিল ২০ মিটার পুরু বরফের চাদর। সব মিলিয়ে আয়তন প্রায় ২ কোটি ৭০ লক্ষ ঘন মিটার। অর্থাৎ, তা মিশরের গ্রেট পিরামিডের আয়তনের প্রায় ১০ গুণ। এই বিপুলাকার পাথর ও বরফের মিশ্রণ পর্বতের খাড়াই ঢাল বেয়ে পরবর্তী আধ মিনিটেই নেমে আসে প্রায় ২ কিলোমিটার পথ। বাকিটা ইতিহাস। নিঃশব্দেই ভারতের বুকে ঘটে যায় ভয়ংকর এক বিপর্যয়। 

কথা হচ্ছে চলতি বছরেই উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় ঘটে যাওয়া বন্যা এবং বীভৎস ধ্বস নিয়ে। যা মুহূর্তেই প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল প্রায় ২০০ জন মানুষের। ধ্বংস করে দিয়েছিল ৫টি সেতু, অজস্র বাড়িঘর, বিষ্ণুগাদ হাইড্রোলিক পাওয়ার প্ল্যান্ট। প্লাবিত করেছিল অলকানন্দা, ধৌলিগঙ্গ-সহ একাধিক উত্তর ভারতের নদী উপত্যকাকে। কিন্তু এমন দুর্ঘটনার কারণ কী? প্রায় চার মাসের তদন্তের পর এবার বিপর্যয়ের উৎপত্তি এবং তার সম্পূর্ণ রহস্যের সমাধান করলেন বিজ্ঞানীরা। উপগ্রহের ছবি, ভূমিকম্পের রেকর্ড, প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ-সহ কমিউটারে এআই-মারফত তৈরি সম্ভাব্য পরিস্থিতির সিমুলেশন থেকে শেষ অবধি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন তাঁরা। না, কোনো একটি ঘটনা নয়, বরং ধারাবাহিক কিছু ঘটনার কোলাজই ভয়ঙ্কর রূপ দিয়েছিল পরিস্থিতির। গত ১০ জুন প্রকাশিত হয়েছে সেই গবেষণাপত্র।

কীভাবে, কোন সময়ে ঠিক শুরু হয়েছিল এই ধ্বস— তা বলা হয়েছে আগেই। কিন্তু বিশালাকার এই পাথরের চাঁই কি হঠাৎই খসে পড়ল? না, তেমনটা নয়। কানাডার ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওমরফোলজির গবেষক ড্যানিয়াল সুগার জানাচ্ছেন, প্রাথমিকভাবে রন্টি পর্বতের শিখরে একটি হিমবাহ হ্রদের বিস্ফোরণে প্লাবন দেখা দেয়। সেই জলের তোড়েই খসে পড়েছিল পাথরের শিলাখণ্ডটি। তবে সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে এভাবে ভেঙে পড়ত না পাথরের চাঁই। গবেষকরা বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করে দেখেন পাহাড়ের পাথুরে শরীরে ফাটল দেখা গিয়েছিল ২০১৮ সালেই। ফলে আলগা হয়ে ছিল প্রস্তরখণ্ডটি। প্লাবনের জলের তোড়ে তা ছেড়ে যায় পাহাড়ের গা থেকে। 

খাড়াই ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার সময়, ঘর্ষণের কারণে গলে যায় ওই প্রস্তরখণ্ডে স্তরীভূত বরফ। যা আরও বাড়িয়ে দেয় ধ্বসের গতি। তারপর তা আঘাত করে গাদ উপত্যকায়। হিরোশিমা বিস্ফোরণের থেকেও ১৫ গুণ শক্তিশালী ছিল সেই সংঘর্ষ। ফলত, মুহূর্তেই টুকরো টুকরো হয়ে যায় পাথরের বিশাল চাঁইটি। তৈরি হয় ধুলোর মেঘ। সেইসঙ্গে বহমান নদীর স্রোতে পাথর, ধুলো, বোল্ডার ও বরফ মিশে পিচ্ছিল এক স্রোত গড়িয়ে নামতে থাকে গিরিখাত ধরে। এই কাদাস্রোত যখন নির্মায়মাণ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছে গিয়ে পৌঁছায় তখন আর কিছুই করার ছিল না। কর্মীরা সেভাবে বুঝেও উঠতে পারেননি ধেয়ে আসছে তীব্র মাত্রার বিপদ। 

আরও পড়ুন
২৪ ঘণ্টায় ৪৫টি জঙ্গলে আগুন উত্তরাখণ্ডে

এই বিস্তারিত মূল্যায়নই পরবর্তী সময়ে হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে বলেই ধারণা গবেষকদের। কিন্তু কীভাবে ঠেকানো যাবে এমন বিপত্তি? তাঁদের অভিমত, মূলত জলবায়ু পরিবর্তনই ক্ষতিগ্রস্ত করছে হিমালয়ের পরিবেশের ভারসাম্য। সেইসঙ্গে মানুষের কার্যকলাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে বিপর্যয়ের তীব্রতা এবং সম্ভাবনাও। উত্তরাখণ্ড এর আগেও একাধিক প্রকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। সেই বিষয়টিতেই জোর দিচ্ছেন গবেষকরা। পার্বত্য পরিবেশের স্থিতি ফেরানোর মাধ্যমেই এই প্রাবল্যকে খানিকটা আটকানো যায় বলে, জানাচ্ছেন তাঁরা। সেইসঙ্গে পাহাড়ের ওপরে দরকার কোনো স্থায়ী আবহাওয়া কেন্দ্রের। যেখান থেকে অনবরত মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে ভূমিকম্প, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার মতো বিষয়গুলিকে। তা না হলে, পূর্বাভাস পাওয়া দুরূহ হয়ে থাকবে আগামীতেও…

আরও পড়ুন
নিধন রুখতে বৃক্ষ-আলিঙ্গন মহিলাদের, উত্তরাখণ্ডে ‘চিপকো আন্দোলনে’র ছায়া

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
স্বামীর পৈতৃক সম্পত্তির সমান অংশীদার স্ত্রী-ও, পথ দেখাচ্ছে উত্তরাখণ্ড