রোহিঙ্গা শিবির থেকে বিশ্বজয়ী বডিবিল্ডার, নূর কবিরের জীবন যেন এক রূপকথা

৯০-এর দশকের শেষের দিকে মায়ানমারজুড়ে প্রবল পরাক্রমে চলেছে সামরিক শাসন। আর তার সঙ্গে তীব্র হয়ে উঠেছে জাতি-বিদ্বেষও। রোহিঙ্গা বিরোধী দাঙ্গার শুরু সেই সেদিন থেকেই। সীমান্ত পেরিয়ে অনেকেই এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাংলাদেশে। সেই শরণার্থী শিবিরেই জন্ম নিয়েছিলেন নূর কবির। আশ্রয় তো কোনোরকমে জুটল। কিন্তু খাবার নেই, পানীয় জল নেই। বাংলাদেশ সরকার এবং কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে রেশন পাঠানো হত। কিন্তু তাও পর্যাপ্ত নয়। বহু সময় দিনে একবেলা আধপেটা খেয়ে থাকতে হত, জানাচ্ছেন নূর কবির। আর এই অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নিচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবন শহরের বিখ্যাত বডিবিল্ডিং কম্পিটিশন আইএসএন ক্লাসিকের মঞ্চ থেকেই। তাঁর হাতেই উঠে এল এবছরের বিজয়ীর পুরস্কার।

শরণার্থী শিবির থেকে বডিবিল্ডিং-এর বিশ্বজয়ের রাস্তাটা সহজ ছিল না। রোহিঙ্গা শিবিরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই সারাজীবন থাকতে হবে, একথা কোনোদিনই মেনে নিতে পারতেন না নূর। সবসময় চাইতেন সেখান থেকে পালিয়ে যেতে। কিন্তু বাবা-মা এবং অন্যান্যরা ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিলেন। নূর মেনে নিতে পারেননি। ২০১২ সালে ১৬ বছরের নূর একা একাই সাগর পাড়ি দিলেন। পৌঁছে গেলেন অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু বিদেশে পৌঁছলেই হবে না। নাগরিকত্বও পেতে হবে। কয়েকমাস ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকার পর মিলল অন্তর্বর্তীকালীন ভিসা। নাগরিকত্ব পেয়ে প্রথমেই যোগাযোগ করলেন বাড়ির সঙ্গে। ততদিনে ছেলের সন্ধান না পেয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন মা। এভাবে কাউকে কিছু না বলে একা একা তো ছেলে কোথাও যায় না! তবে শেষ পর্যন্ত সে যে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যেতে পেরেছে, এটুকুই শান্তি।

অস্ট্রেলিয়াতেই শুরু হল নূর কবিরের শিক্ষা। বেশ কিছু বন্ধুবান্ধবও জুটে গেল। নূর অবাক হয়ে দেখতেন, এখানে কেউ তাঁকে শরণার্থী বলে উপহাস করেন না। বন্ধুদের সূত্রেই একদিন আলাপ হয়ে গেল শরণার্থী বিষয়ক প্রশিক্ষিক ফিল নিক্সনের সঙ্গে। নূর কবিরের স্বাস্থ্য দেখে তাঁকে শরীরচর্চায় উৎসাহিত করেন নিক্সন। ছোট থেকেই স্বাস্থ্যসচেতন ছিলেন নূর। এবার শুরু হল নিয়মিত জিমে যাওয়া। দেখতে দেখতে শরীরের মাসল পুষ্ট হয়ে উঠতে থাকল। গতবছর তাই বন্ধুরাই জোর করে তাঁর নাম দিয়ে দিল আইএসএন ক্লাসিক প্রতিযোগিতায়। কিন্তু শুধু নাম দিলেই তো হবে না। চাই উপযুক্ত প্রশিক্ষণও। নূরের জীবনের কথা শুনে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এলেন কোচ সিমন স্ট্রোকটন।

এভাবেই আজ বিশ্বজয়ী হয়ে উঠলেন একদা শরণার্থী শিবিরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জন্ম নেওয়া নূর কবির। নিজের সেই পরিচয় নিয়ে একটুও লজ্জিত নন নূর। বরং তিনি মনে করেন, তাঁর এই সাফল্য অন্যান্য রোহিঙ্গাদেরও অনুপ্রাণিত করবে। আর সেইসঙ্গে আজও নানা জায়গায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে রক্ষণশীল মানসিকতা থেকে গিয়েছে, তাকেও ভাঙতে পারবেন তিনি। ভবিষ্যতে পুষ্টিবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতে চান নূর। সেইসঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় স্তরের বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতা জয়ের স্বপ্নও আছে তাঁর। তবে সমস্ত জায়গায় নিজের আত্মপরিচয় জোরের সঙ্গে প্রকাশ করবেন তিনি। উপযুক্ত সুযোগ পেলে তাঁরা তো কারোর থেকে পিছিয়ে থাকবেন না।

আরও পড়ুন
পা দিয়ে তির ছুঁড়ে বিশ্বজয়, প্যারালিম্পিকেও আমেরিকার ভরসা সেই তীরন্দাজই

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
নিঃসঙ্গ মৃত্যুর ভয়ে আতঙ্কিত জাপানের ‘বাটারফ্লাই লেডি’