পথের পাশে, রেল লাইনে…

ইলাহাবাদের পুরানা কাটরার একেবারে কাছাকাছি, পরেট-ন্যাড়ামুড়ো জমি পেরোলেই বড়ো রাস্তা— গাছি— পাকা সড়ক, পিচ বাঁধানো। তার গা লাগোয়া নরোয়া— নারোয়া বা নর্দমা। বেশ বড়োসড়ো নর্দমা। খুব ভোরে সেখানে পেট খুলাসা করার কাতার— সারি। সারি সারি মহিলা ও পুরুষ, সঙ্গে ছোটোরাও— ‘ময়দান’ অভ্যাস করছে। কোম্পানি বাগান— কোম্পানি বাগে তো মলত্যাগ— হাগার জন্য ‘ময়দান’— মাঠ তো আছেই। কাছে পর্যাপ্ত জল, ফলে শৌচকার্যে— হেগে ছোঁচানোর কোনো অসুবিধাই নেই। কিন্তু পাক্কি— বড়ো রাস্তা— পিচ রাস্তার গা লাগোয়া নরোয়া— নারোয়া বা নর্দমাতে পোঁদ খুলে, পোঁদ ঝুলিয়ে হাগার ব্যাপারটা প্রায় সর্বজনীন। খুব ভোর ভোর, সন্ধ্যা বা গভীর রাতে পাকা— পিচ বাঁধানো রাস্তা দিয়ে অতি দ্রুত ছুটে যাওয়া জিপ, অ্যাম্বাস্যাডার বা লড়ির হেডলাইট চকিত আলোক স্পর্শে হাগুণ্ডিদের যেটুকু শর্ম— লজ্জা বা অস্বস্তি দিতে পারে, তার ফলাফলে মহিলারা শাড়ি দিয়ে তাদের মাথার ঘোমটাকে আরও খানিকটা টেনে দেয় সামনে। ‘লজ্জা’— ‘হায়া’— ‘শরম’— ‘শর্ম’ বাঁচানোর জন্য। আর পুরুষেরা তাদের মাথাসমেত মুখটা দুহাটুর ওপর রেখে ডান অথবা বাঁ হাতের কনুই রেখে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে, সংস্কার— লজ্জা। ছয়ের দশক— ষাটের দশক, সাতের দশক— সত্তর দশকেও পরেট লাগোয়া নরোয়া বা নারোয়ার এই চিত্র নিয়মিত। খুল্লায়— খোলা জায়গায়— ‘ময়দান’ এই শব্দটির অন্য কোনো ইমেজারিতে পেট পরিষ্কার করা চলতে থাকে। ছুটন্ত ট্রেনের জানলা থেকে দেখেছি, ভোর ভোর, এমনকি একটু বেলাতেও ট্রেন লাইন— রেল লাইনের পাশে সারি সারি হাগা-অভিলাষী। পাশে জলপাত্র, কখনও জলপাত্র নেইও। চলমান ট্রেনের জানলা থেকে কে দেখনে না দেখছে, তাদের তা নিয়ে বিন্দুমাত্র কোনো হায়া-শরম আছে বলে মনে হয় না। ইলাহাবাদে শীতে বুলবুল-লড়াইয়ের কথা আগে লিখেছি। লোহার তৈরি ঢালাই নয়, পেটাই লোহার তৈরি দাঁড়, যেন অনেকটা ইংরেজির ওয়াই চেহারার। ধরার হাতল আছে যেমন ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের থাকে। সেই দাঁড়— আড্ডার ওপর লাল রঙের, নয়তো কালো রেশমি কার জড়ানো থাকে। বুলবুলের পায়েও লাল কার। বেশ লম্বা, অনেকটা বড়ো, যাতে সে লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে বেশি দূরে চলে না যেতে পারে। এইসব বুলবুলিরা অবশ্যই পুং এবং বাহারি ঝোটনদার। তারা নিজেদের মাথার ঝুঁটি ফুলিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য পাখিটিকে আক্রমণ করে। শক্ত ঠোঁটে ঠুকরে দেয়। লড়াইয়ের বুলবুলদের অনেক সময় ছেঁটে দেওয়া হয় ঝুঁটি। ফলে বিপক্ষের পাখিটি তার মাথার ঝোটনটি চঞ্চু আঘাতে ছিঁড়ে না দিতে পারে। আহিরপল্লির জামাই রাজা রাম— রাজা রাম যাদো, রাজারাম ইয়াদো বা রাজা রাম যাদব। রাজারাম নাটাখোটা— বেঁটে। খর্বকায় রাজারামের পত্নীবিয়োগ হয়েছে বহু বছর আগে, আমি ছয় দশকের কথা বলছি। রাজারামের দুই কন্যা, দুই পুত্র। বড়ো কন্যার বিবাহ হয়ে গেছে। তারপর গুড্ডি। গুড্ডির পর, পর পর দুটি পুত্র সন্তান— গুড্ডির ছোটো দুই ভাই— পোরে আর রম্মু বা রাম্মু। পোরে— পোরেলাল যাদব বুলবুল লড়াইয়ে খুব দড়। এখানে বলে রাখা ভালো, ছয় আর সাতের দশকে ইলাহাবাদ— এলাহাবাদ বা প্রয়াগরাজে প্রতি শীতে যে অতিবিখ্যাত বুলবুলির লড়াই, পোরেলাল যাদব তার অন্যতম খেলুড়ে। এই লড়াইয়ে বাজি হয় টাকার। তোমার পোষা— পালতু বুলবুল জিতলে পাবে, হারলে যাবে। মূলত বুলবুল-লড়াই তথাকথিত প্রান্তিক জন-চামার, পাশি, আহির, কাহার, খটিক, শিকারি, কুনকিদের খেলা। পোরেলাল যাদব তার পরনের লুঙ্গিটি ভালো করে কোমরের সঙ্গে বেঁধে হাতে পোষা— পালতু লড়ুয়ে বুলবুল পাখির আড্ডাটি নিয়ে বেরিয়ে পড়বে সকাল সকাল, এরকমভাবে অনেকেই তো তাদের নিজস্ব লড়াকু বুলবুল নিয়ে চলে আসে জংয়ের ময়দানে— লড়াইয়ের মাঠে। সেখানে তখন অনেক অনেক লড়াইয়ের বুলবুল। গুড্ডি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে। তার গানের গলাটি সুন্দর। মহেন্দ্র কাপুরের গলায় গাওয়া ‘হামরাজ’ ছবির গান ‘চলো ইকবার ফিরসে/ আজনবি বন যায়ে হম দোনো’— এই গানটি সে বড়ো ভালো গায়। সেইসঙ্গে লতাজি ও আশাজির গান। গুড্ডির গলায় দর্দ ও মিঠাস— দুই-ই আছে। আমার বড়ো মাসিমা— মায়ের আপন বড়দি ঊষারানি ভট্টাচার্যর মেজোপুত্র হিরন্ময় ভট্টাচার্য— আমাদের সর্বজনপ্রিয় মেজদা— বাপ্পাদা এই আহিরিন— গুড্ডির প্রেমে পড়ে ইলাহাবাদে গিয়ে— ৮৫৩/৭৩২ নম্বর বাড়িতে— বড়ো মাসি— রেণুমাসির কাছে গিয়ে। মেজদা সামান্য খর্বকায়। কিন্তু যৌবনে অসম্ভব রূপবান হিরন্ময় ভট্টাচার্য যেন শশী কাপুর। এমনকি হাসিটা পর্যন্ত। গুড্ডি তো বাপ্পায় ফিদা। বাপ্পাও হয়তো। কিন্তু এইসব প্রেম-পিরিত তো আসলে আঁখো কি নশা— নেশা। আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড। সেই যে কাজী নজরুল ইসলামের গান আছে না— ‘প্রিয় যেন প্রেম ভুলো না/ এ মিনতি করি হে/ হৃদয় কারে নাহি দিও/ আমারে বিস্মরিয়ে/ চোখের বাহির বলে মনের বাহির হলে…/ আমার সমাধি পরে দাঁড়াও ক্ষণেক তরে/ ভুলিব বিরহ জ্বালা ও চরণ ধরিয়ে…’। গুড্ডি নজরুল গীতির খবর রাখে না। বাপ্পাদাও কী তেমন করে রাখে, এই নজরুল-নির্মাণ। তবে ইলাহাবাদের পুরানা কাটরার দোতলা বাড়ির ছাদে প্রবল শীতের দিনে বালতি বালতি গরম জল— গর্ম পানি পৌঁছে দিয়েছে গুড্ডি, মেজদার স্নানের জন্য। সেটা ১৯৬৭-৬৮ হবে। গুড্ডি প্রায় সারাদিনই থাকে রেণুমাসির বাড়িতে, ঘরে তালা-চাবি দিয়ে। প্রায়ই খুব অন্যমনস্ক থাকে গুড্ডি, কেন কে জানে! মানুদি, মঞ্জুদির বন্ধু— বান্ধবী— সহেলি সে। মন আনমনা থাকার জন্য গুড্ডি প্রায়ই তাকে বলা কথার উত্তর দেয় না অথবা দিতে পারে না। তখন মানুদি, মঞ্জুদি এমনকি বড়োমাসি— রেণুমাসিও তাঁকে বহেরুল বলে। বহেরুল, বহেরা অর্থ কালা। কানে কালা— কানে ‘খাটো’কে পূর্ববঙ্গে বয়রা বলা হত। আবার হিন্দি বলয়ে বয়ের মানে কুল। আবার কুলহড় মানে পোড়া মাটির ভাঁড়, কুলহাড়ি অর্থে কুড়ুল। গুড্ডিকে বহুরুল-এর সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে রুল রুল রুল বলা হত। এতে— এই উচ্চারণে বেশ চটেই যেত গুড্ডি কিন্তু মুখে তেমন করে কিছু বলত না। বরং মাসির আশখাল— রান্নাঘরের পাশে বসে গুনিছে চাওল— আতপ চালের ভাত, সেইসঙ্গে তনিসে— ‘ইতনি সি’-টা ‘তনি সি’ বা ‘তনি সে’ হয়ে যায় প্রচলিত উচ্চারণে, কলোকাল হিন্দিতে। গুড্ডির মাথায়ন জুঁ— উকুন। ইলাহাবাদে উকুন— জুঁ বা জুঁহা বলে অনেক নারীর মাথায়, সে কথা আগেই লিখে এসেছি। বড়োমাসি— রেণুমাসির তিন ছেলে রঞ্জিত ভট্টাচার্য, দিলীপ ভট্টাচার্য, অশোক ভট্টাচার্য। মঙ্কু বা মনকু, বেড়ু, বাবু— ডাকনামে এরা সবাই এইরকম। তো সেই বাবুদা— মানে রেণুমাসির আপাতভাবে ছোটো ছেলে অশোর ভট্টাচার্যর সঙ্গেও অনেক পরে গুড্ডির অতিগোপন প্রেম। সেই বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে অনেক অনেক পরে। মানে বাপ্পা-গুড্ডি পর্ব মিটে যাওয়ার পর। এইসব তথাকথিত প্রেমের কোনো পরিণতি হয় না কখনওই। ‘মঘঘা’— এই শব্দটা ইলাহাবাদে খুব চলে, বনারসেও সামান্য সামান্য। ‘মঘঘা’ শব্দের অর্থ গাঁইয়া, গাঁওয়ার, বোকা। দিহাতি— গ্রামের মানুষকেও ‘মঘঘা’ বা ‘মঘাইয়া’ বলতে শুনেছি। বনারস-কাশীর ‘মঘাইয়া পান’ অতি বিখ্যাত। কাশীতে পান আসে মেদিনীপুর থেকে। আমি ছয় ও সাতের দশকের কথা বলছি। অখণ্ড মেদিনীপুর। পূর্ব উত্তরপ্রদেশের গঙ্গা সংলগ্ন জমিতে— বালি মাখা দোঁয়াশ মাটি— পয়োস্তি জমি, সেখানে কাকরি, ক্ষিরা— ছোটো শশা, তরমুজ, খরমুজ— দারুণ চাষ হয়। এই উর্বর— পয়োস্তি জমিতে কোঁড়ো— কুমড়োও খুবই ভালো ফলে। তো ইলাহাবাদে ‘কা বে মথাইয়া’ একটা সম্বোধন বিশেষ। যেমন ‘কাশ মে’, ‘কা বে’। উত্তরে, ‘নাহি’ বা ‘নাহি বে’। ‘কা গুরু’, ‘কা রাজা’— এসবও কথার লবজ, সম্বোধনের শুরুয়াত। গোড়াতেই পরেটের পাশে আহিরিন, চামাইন, নাহারসি, মেথারানি— এঁদের মাঠ-ফেরা— নর্দমায় বসে হাগার কথা বলেছি। ভোরে বা সকালে পায়খানা করার সময় ছোটোদের অনেকের মুখেই বাসি রুটি, ভেতরে চিনি— শক্কর, গুড়— গুড় বা সবজি— তরকারি দেওয়া। দুচোখে পিচুটি, নাকে পোঁটা— সর্দির ভসভস, এদিকে ‘মাল’ বেরচ্ছে তলা দিয়ে, আর মুখে মুখে, দাঁতে-জিভে চলছে চিবোনো। রাজারাম যাদব— গুড্ডি, গুড্ডির দিদি— ভদায়র, পোরে আর রামুর— রামুর বাপ রাজারাম— সংক্ষেপে আরআর কোম্পানি বাগে মাঠ ফিরতে যায়, তেমন বেশি চাপ থাকলে তলপেটে, তখন পরেটের পাশে নরোয়াতেই। রাজারাম— স্থানীয় লোকমুখে আরআর— বুক দিয়ে আরি মেশিন— কাঠ কাটার ভারি, ধারালো করাত ঠেলে যমুনা— যম্নাজির দিকে কিনারে কিলা— আকবর বাদশার তৈরি কিলা— কিল্লা— কেল্লা— দুর্গের ভেতর কাঠের ওজনদার। মোটাসোটা গুঁড়ি থেকে তকা বার করে আনা হয়। আরআর— রাজারাম যাদব, সেই কাঠকলে— করাতকলে আরি মেশিন চালায়। তার পরনে সারাক্ষণই ধারিদার— চেকদার— ডোরাকাটা রঙিন আন্ডারওয়ার— আন্ডারপ্যান্ট— চাঢঢি। আরআর— রাজারাম যাদব বিড়ি খায়— বিড়ি পিয়ে, শারাব— ঠররা— দিশি মদ পিয়ে, সিদ্ধি-ভাঙ পিয়ে, পিত্যা হ্যায়। আহিরপল্লিতে দারু— মদ ও ভাঙ— দুটোই খুব চালু— কমন নেশা। সেইসঙ্গে আছে গাঞ্জা— গাঁজা, বিড়ি-সিগারেট। আহিরিনরা ভাঙের তরিবত করে। ভিজিয়ে রাখে কাঁসা বা অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে। পাথরের শিলে ভাঙ— সিদ্ধি পেষাই হয়। তার থেকে সবুজ রঙের গোলা। গুলি খেলার মার্বেল— টল চেহারার ভাঙের গোলা গিলে বুত হয়ে থাকেন অনেকেই, ঝিম নেশায়। শরবতও হয় ভাঙের। ঠান্ডাই। পেস্তা, বাদাম, কিশমিশ, দুধ, খোয়া, ক্ষীর, গোলমরিচ গুঁড়ো, চিনি— জমে গেল। এ গ্লাস থেকে ও গ্লাসে ভাঙের শরবত ঢালাঢালি, সে তো এক দেখার জিনিস। অনেকটা উঁচু থেকেই গ্লাস থেকে গ্লাসান্তরে নেমে আসে ভাঙধারা। রাজারামকে নিয়ে কেউ কেউ গান বাঁধেন, প্যারোডি— রুথ হ্যায় মিলন কি সাথি মেরে হারে/ রাজারাম ব্যয়ঠা হ্যায় নরোয়া কিনারে…’। কখনও বলা হয় আরআর। মুকেশের গাওয়া একটি গান তখন খুব হিট করেছে, সেটা সাত দশকের শুরুয়াত। গানটা এরকম— গানের কথাটা বলছি, ‘রুথ হ্যায় মিলন কি সাথী মেরে হারে/ মুখে কোই লে চল বাহোঁ কে সহারে/ বাহোঁ মে, ক্ষেতোঁ মে, নদীয়া কিনারে…’। সেই গানটারই প্যারোডি— ‘আরআর ব্যয়ঠা হ্যায় নরোয়া কিনারে…’। হাগার কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল। কথায় কথায়, লেখায় লেখায় রেললাইন বা ট্রেন লাইনের ধারে বসে সার বেঁধে মলত্যাগের ছবিটি বলেছি। তখন তো ট্রেন কামরার পায়খানার প্যান থেকে গড়িয়ে নাম, থুপ থুপিয়া, থপথপিয়া নামা গু-মুত— সবই রেললাইনের স্লিপার বা পাটরির ওপর। পরে তা পরিষ্কার করেন ধাঙড়রা। ইদানিং কয়েক বছর হল এই কু-ব্যবস্থা বদলেছে। ছয়ের দশকে রেলের লাইনে— ট্রেন লাইনে স্লিপার বা পাটরি তৈরি হয় সেগুন কাঠ প্রথমে চেরাই করে, তারপর সাইজ করে তক্তা। সেই পাটরি বা স্লিপার চুরি হয়ে যায় অনলীলায়, দামি পোক্ত কাঠ— সম্ভবত সেগুন। এরপর ঢালাই করা— সিমেন্ট ঢালাইয়ের স্লিপার বা পাটরি। স্টোন চিপ, সিমেন্ট-বালি— ঢালাইয়ের চালু ফর্মুলা যেমনটি হয়ে থাকে। রেলের বিপুল সম্পত্তি, তা চুরি করার জন্য ওয়াগান-ভাঙিয়ে, ওয়াগান-ব্রোকাররা সবসময় সক্রিয়। পশ্চিমবাংলায় ছয় এবং সাতের দশকে এই রেল ওয়াগান ভাঙার দল সক্রিয় ছিল। এরা সশস্ত্র তো থাকতই। ছোটো, প্রচলিত হাতিয়ার— পাইপগান, ওয়ানশটার, কখনও দিশি রিভলভার বা পিস্তল— কাট্টা বা কট্টা, এমনটা। আবার ক্বচিৎ অটোমেটিক ছোটো ওয়েপন— স্পল ওয়েপন— ‘ওয়েরলি স্কট’ বা ‘কোল্ট’ রিভলবার, পিস্তলও। পয়েন্ট টোয়েন্টি বোরের হামবর— ওয়ান শটারও থাকত। পাইপগান— দেশি লেদ কারখানায় ওয়েল্ডিং, বোর করে তৈরি ছিটকিনি পাইপগান বেশিরভাগই পয়েন্ট থ্রি নট থ্রি, নয়তো পয়েন্ট থ্রি এইট। আসলে পয়েন্ট্র থ্রি নট থ্রি পুলিশ-মিলিটারি রাইফেলের গুলি। পাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ। সাত দশকে পার্টি চ্যানেল— রাজনৈতিক সূত্রে এক পিস পয়েন্ট থ্রি নট থ্রি দানা— গুলি সাড়ে তিনটাকা, তিনটাকা বড়োজোর। কাশীপুর— ইছাপুর গানশেল ফ্যাক্টরি থেকে চোরাই পথে গুলি আসে। লোহার মজবুত, কালো ক্লিপে পাঁচটা বা ছটা পয়েন্ট থ্রি নট থ্রি, সোনালি, চেহারায় যেন মিসাইল, পুরোটাই পেতলের ঢাকনিতে মোড়া। পয়েন্ট থ্রি এইট দানা— গুলির মাথায় সিসে। হাতের আঙুলের এক করের থেকে সামান্য বড়ো এই বুলেটও তিনটাকা— সাতের দশকে। কোল্ট আর ওয়েবলি স্কট, যা মূলত পুলিশ ব্যবহার করে থাকে, সেই দুই ব্র্যান্ডেড রিভলবারের জন্য এই পয়েন্ট থ্রি এইট দানা— গুলি। আর সাতের দশকে ইন্ডিয়ান আর্মিতে-মিলিটারিতে পয়েন্ট ফোর ফাইভ পিস্তল ব্যবহার করা হয়। ভারতীয় ফওজ বা ফৌজের ব্যবহার করা এই পয়েন্ট ফোর ফাইভ পিস্তল ভেদ শক্তিতে পয়েন্ট থ্রি এইট দানার থেকে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী। পয়েন্ট টোয়ান্টি— কুড়ি কোরের গুলি পাওয়া খুবই ফৈজতের, প্রায় অদৃশ্য সেই হালকা হলুদ রঙের কার্তুজ। দোনলা ও একনলা বন্দুকে পয়েন্ট টুয়েলভ বোর গুলি ব্যবহার করা হয়। এই কার্তুজ দুরকমের। একটা ছররা, আর একটা বুলেট। ছররা দিয়ে পাখি মারা হয়। বুলেট ঠেকিয়ে মাথায় মারলে মানুষও মারা যায়— হত্যা করা সম্ভব। টুয়েলভ বোর বা বারো বোরের— পয়েন্ট টুয়েলভ বোরের ওপরের কভারটি মোটা কাগজের। পিসবোর্ড জাতীয় কাগজ, লাল রঙের। বারো বোরের গুলিতে ড্যাম্প ধরে যায় সহজেই। পয়েন্ট টুয়েলভ বোর-এর বুলেট দিয়ে বাঘ ও মানুষ— দুই-ই হত্যা করা যায়। এখন অবশ্য বাঘ শিকারে নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু মানুষ শিকারে কোনো নিষেধ নেই। এখন অবশ্য পয়েন্ট ফোর ফাইভ-এর ব্যবহার খুব বেশি হয় না। এখন পিস্তল নাইন এমএম। সেইসব পিস্তল ইজরায়েলের, মেড ইন ইজরায়েল এবং মেড ইন চায়না। বরাবরই রিপিটার— রাইফেল, রিপিটার অর্থে ঘড়িও হয়, মেড ইন বেলজিয়াম— সবচেয়ে ভালো, মানে উল্লেখযোগ্য আরকি। ইউরোপের ছোট্ট দেশ বেলজিয়াম রাইফেল, বন্দুক তৈরিতে অতি দড়— পোক্ত। আফ্রিকায় তার উপনিবেশ— কলোনি— কঙ্গো। সেখানে পাঁচ ও ছয়ের দশকে প্যাট্রিস লুমুম্বার নেতৃত্বে বেলজিয়ান ইম্পেরেলিজম— বেলজিয়াম সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, দীর্ঘ লড়াই। প্যাট্রিস লুমুম্বাকে হত্যা করা হয়। তাঁর নামে প্যাট্রিস লুমুম্বা ইউনিভার্সিটি ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে। সেখানে আফ্রো-এশিয় ছাত্ররা পড়াশোনা করতেন। বারো বোরের বুলেট বা ছররা জলে ভিজে গেলে, ড্যাম্প লাগলে চিত্তির, অসুবিধা। ফায়ার হতে সময় নেয় বা হয় না। আর বন্দুকের, রিভলভার, রাইফেলের ট্রিগার যদি একবার ফেল করে, তো ব্যস। হয়ে গেল। সমস্ত আত্মবিশ্বাসের দফা গ্যয়া, এই অভিজ্ঞতা যিনি এই ট্রিগার ফায়ার ও বুলেটের সংযোগে গুলি বা ছটার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন, তিনিই জানেন সমস্যাটা ঠিক কেমন। এই অভিজ্ঞতা ব্যক্তিজীবনে না হলে বলা যায় না। এবারের মুছে যায় শুরু হয়েছিল টাট্টি, টাট্টিঘর, টাট্টিখানা— পায়খানাম খুলে আম ময়দান মে শোচ, ইত্যাদি প্রভৃতি নিয়ে। রেল ইয়ার্ডে থেমে থাকা ট্রেনের পায়খানায় ঢুকে পড়ে অনেক অনেক ঠেকানাহীন— ঠিকানাশূন্য মানুষ পেট পরিষ্কার করে আসেন, এটা দেখেছি। নিজস্ব অভিজ্ঞতাও রয়েছে এই ব্যাপারে। জীবন এক আশ্চর্য ক্যারামবোর্ড, তার রেড, ব্ল্যাক, হোয়াইট— লাল, কালো, সাদা ঘুঁটি আর স্ট্রাইকার কখন, কোথায় যে ‘পকেট’ হবে, কে জানে!

Powered by Froala Editor